সিবিএন ডেস্ক:
১২ বছর পর জানা গেলো রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান। তার নিয়োগ অবৈধ প্রক্রিয়ায় হয়েছিল উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। বুধবার (১৩ মার্চ) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরী।

অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ উঠলে তাবিউর রহমানের বিষয়ে জানতে চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পত্র দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। পরে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অবশেষে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় কমিটি।

এর আগে ২০১২ সালে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান তাবিউর রহমান। দুই দফায় পদোন্নতি নিয়ে বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক পদে আছেন। এই পদোন্নতিতেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। এরই মধ্যে কয়েকবার শিক্ষক সমিতির নেতাও নির্বাচিত হন। এসব বিষয়ে নিয়োগবঞ্চিত আরেক শিক্ষক মাহামুদুল হকের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল ইউজিসি।

গত ৮ জানুয়ারি ইউজিসির উপসচিব মো. গোলাম দস্তগীর স্বাক্ষরিত পত্রে অভিযোগের বিষয়ে প্রমাণাদিসহ লিখিত বক্তব্য, ওই বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশনের বিপরীতে আদালতের জারিকৃত রুল ও আদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহীত পদক্ষেপের হালনাগাদ তথ্য দিতে বলা হয়েছিল।

ইউজিসিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের পাঠানো চিঠি থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক পদে তাবিউর রহমানের অবৈধ নিয়োগের কারণে নিয়োগবঞ্চিত হন মাহামুদুল হক। সাত বছর আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৯ সালে হাইকোর্টের রায়ে প্রভাষক পদে মাহামুদুল নিয়োগ পান। কিন্তু তিনি ওই রায় অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় ২০২২ সালে আবার হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৪ মার্চ জালিয়াতির কারণে কেন তাবিউর রহমানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।

অন্যদিকে ২০১৩ সালের হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, কেন মাহামুদুল হককে ২০১২ সালের বাছাই বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী নিয়োগ কার্যকর করে জ্যেষ্ঠতা ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না, তাও ওই রুলে জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। এরপর হাইকোর্টের আগের রায় ও চলমান রুল অনুযায়ী তাবিউরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত এবং তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুদক ও ইউজিসিতে পাঠানো এক চিঠিতে অনুরোধ করেন মাহামুদুল। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক ইউজিসির কাছে এ ব্যাপারে জানতে চায়। দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় ইউজিসি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্র অনুসন্ধান করে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৯ অক্টোবর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের জন্য অধ্যাপক-সহযোগী অধ্যাপক পদে একটি এবং সহকারী অধ্যাপক-প্রভাষক দুটি স্থায়ী পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে তাবিউর রহমানসহ ২২ জন প্রভাষক পদে আবেদন করেন। পরের বছরের ১৩ জানুয়ারি প্রভাষক পদের জন্য বাছাই বোর্ড হয়। বাছাই বোর্ড যথাক্রমে মো. মাহামুদুল হক ও নিয়ামুন নাহারকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রেখে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। কিন্তু বাছাই বোর্ডের সুপারিশপত্রে দেখা যায়, জালিয়াতি করে অপেক্ষমাণ তালিকায় তৃতীয় হিসেবে তাবিউর রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বাছাই বোর্ডের সুপারিশপত্রে দেখা যায়, কম্পিউটারে কম্পোজকৃত মেধাক্রম অনুসারে শব্দটি কলম দিয়ে কেটে যেকোনো শব্দটি লেখা হয়েছে সুপারিশপত্রে। এতে বলা হয়েছে, চূড়ান্তভাবে মনোনয়নপ্রাপ্ত আবেদনকারী ওই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করতে অপারগ হলে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে প্রথমজনকে নিয়োগ করার সুপারিশ করা হলো। অপেক্ষমাণ তালিকার প্রথমজন যোগদানে অপারগ হলে অপেক্ষমাণ তালিকার দ্বিতীয়জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হলো। অপেক্ষমাণ তালিকার তৃতীয়জন সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। কারণ, ওই সিরিয়ালই ছিল না। এজন্য যে দুটি পদের বিপরীতে দুজনকে তালিকায় রাখা হয়।

এরপর ১৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ২১তম সিন্ডিকেটে অপেক্ষমাণ তালিকায় দুজনের পরিবর্তে তৃতীয়জন তাবিউর রহমানের নাম অনুমোদন করা হয় এবং বলা হয় নিচের তালিকা থেকে যে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে। সিরিয়াল রাখা হয়-১. মো. মাহামুদুল হক, ২. নিয়ামুন নাহার, ৩. তাবিউর রহমান। এতে মেধাতালিকার প্রথমজন যোগদান না করায় তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। সেখানে অপেক্ষমাণ তালিকায় দুজনের পরিবর্তে জালিয়াতি করে তাবিউরের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সিন্ডিকেটে অনুমোদন দেওয়া হয়।

একই সিন্ডিকেটে (২১তম) অনুমোদনপ্রাপ্ত ‘যে কাউকে’ শব্দটি ২২তম সিন্ডিকেটে সিন্ডিকেট সদস্যদের আপত্তির কারণে বাতিল করা হয়। অর্থাৎ অপেক্ষমাণ তালিকার প্রথমজন মো. মাহামুদুল হক এবং দ্বিতীয়জন নিয়ামুন নাহার নিয়োগ পান সুপারিশ ও সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। ২২তম সিন্ডিকেটেও জালিয়াতি করা হয়। যে কাউকে শব্দটি বাতিল করা হয় বটে; কিন্তু অপেক্ষমাণ তালিকায় সিরিয়াল পরিবর্তন করা হয়। এতে নিয়োগের জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত দুজন শিক্ষকের নাম লেখার সময় প্রথমজন হিসেবে তাবিউর রহমান এবং দ্বিতীয়জন হিসেবে নিয়ামুন নাহারের নাম লেখা হয়। অপেক্ষমাণ তালিকায় প্রথম মো. মাহামুদুল হকের নাম বাদ দিয়ে অপেক্ষমাণ তালিকার সিরিয়াল পরিবর্তন করা হয়। এছাড়া তাবিউর রহমান প্রধানকে অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক পদের বিপরীতে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ নিয়োগ বাছাই বোর্ড ছিল প্রভাষক পদে। অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক পদের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কেউ দরখাস্ত না করায় অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক পদের কোনও বাছাই বোর্ড হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক পদে প্রার্থী পাওয়া না গেলে এর বিপরীতে প্রভাষক নিয়োগ দিতে হলে নতুন করে বিজ্ঞাপন দিতে হয়। কিন্তু তাবিউর রহমানের নিয়োগের সময় এ নিয়মও অনুসরণ করা হয়নি। এ অবস্থায় অস্থায়ীভাবে প্রভাষক পদে অবৈধভাবে নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে যোগদান করেন তাবিউর।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ পাওয়ার পর জালিয়াতির মাধ্যমে তাবিউর দুই দফায় পদোন্নতি পান। এতেও অনিয়ম করা হয়। সবশেষ গত ১৬ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব শতরুপা তালুকদার স্বাক্ষরিত আদেশে উল্লেখ করা হয়, মাহমুদুল হককে ২০১২ সাল থেকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি। একই সময়ে ওই বিভাগে জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে তাবিউর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইউজিসিকে নির্দেশ দেওয়া হলো।

ইউজিসির নির্দেশনা পেয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মজিব উদ্দিন আহমেদকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। এছাড়া বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবু সালেহ মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান ও রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলমগীর চৌধুরীকে কমিটির সদস্য করা হয়। তদন্ত কমিটির সদস্যরা সব কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত হন তাবিউরকে অবৈধভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে তদন্ত কমিটির সদস্য আলমগীর চৌধুরী ও আবু সালেহ মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে তাবিউর রহমানের নিয়োগ অবৈধ।

এ ব্যাপারে শিক্ষক মাহামুদুল হক বলেন, ‘তাবিউর রহমানের নিয়োগ অবৈধ এবং জালিয়াতির মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে দুদকে আলাদাভাবে অভিযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। একজন ব্যক্তি অবৈধ প্রক্রিয়ায় কীভাবে ১২ বছর ধরে শিক্ষকতা করলেন তা বড় প্রশ্ন।’

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত শিক্ষক তাবিউর রহমানের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও নম্বর বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি। -বাংলাট্রিবিউন