বিবিসি:
বাংলাদেশের প্রধান ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর আমীরের একটি বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনার মুখে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ত্যাগ করছে না।
দলটি বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে বলে দলের নেতারা বলছেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট কার্যকর নেই বলে জামায়াতের আমীরের একটি বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা।
তবে তার এই বক্তব্যকে জামায়াতের আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য নয় বলে দলটির নেতারা এখন উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু বিএনপি নেতাদের অনেকে বলছেন, জোটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দুই দলের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্দেহ সৃষ্টি করা হয়েছে।
বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে আগের মত ঘনিষ্ট সম্পর্ক নেই, এমন আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে।
বিএনপি যখন রাজপথের আন্দোলনে সরকার-বিরোধী দলগুলোকে পাশে আনার চেষ্টা করছে, তখন তাদের পুরোনো ২০-দলীয় জোট কার্যকর নেই বলে শরিক জামায়াতে ইসলামীর আমীরের বক্তব্য নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
জামায়াতের আমীর ডা: শফিকুর রহমানের যে বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে তার বক্তব্য ছিল: জোটকে সক্রিয় করার কোন চিন্তা নেই প্রধান শরিক বিএনপির।
তিনি বলেছেন, এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভরসা করে পথ চলা।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই বক্তব্যটি জামায়াতের আমীরের বক্তব্য বলে দলটি নিশ্চিত করেছে।
তবে জামায়াত নেতা এখন কেন এরকম বক্তব্য দিলেন, এই প্রশ্ন বিএনপির ভেতর থেকে উঠেছে।
‘আনুষ্ঠানিক বা দলীয় বক্তব্য নয়’
নানা আলোচনার মুখে জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের আমীরের বক্তব্যকে আনুষ্ঠানিক বা দলীয় বক্তব্য নয় বলে বলা হয়েছে।
জামায়াতের আমিরের ঐ বক্তব্য সম্পর্কে জানার জন্য সাথে যোগাযোগ করা হলে দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দকে দলের পক্ষে কথা বলার দায়িত্ব দেয়া হয়।
মি: আকন্দ বলেন, তাদের দলে ঘরোয়া আলোচনার একটি বক্তব্য নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করা হচ্ছে।
জামায়াতের যে কোনো বক্তব্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি কিংবা সংবাদ সম্মেলন অথবা জনসভার মাধ্যমে তারা তুলে ধরেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মি.আকন্দ জানান, যে বক্তব্য নিয়ে আলোচনা চলছে, সেই বক্তব্য তাদের দলের আমীর দলীয় একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি-এসব পটভূমিতে জোটের ভূমিকা নিয়ে ব্রিফ করেন।
“এই বক্তব্যটি কোনো অবস্থাতেই সংগঠনের সিদ্ধান্ত হিসাবে জাতির সামনে পেশ করার জন্য নয়। কিন্তু এই বক্তব্যটি যেভাবেই হোক, মিডিয়ায় গেছে,” বলেন মতিউর রহমান আকন্দ।
জামায়াতের আমীরের বক্তব্যকে দলটির পক্ষ থেকে তাদের দলের আনুষ্ঠানিক কোন অবস্থান নয় বলে বলা হচ্ছে।
তবে তার বক্তব্যের পক্ষেই যুক্তি দিতে গিয়ে জামায়াতের একজন সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ২০-দলীয় জোটকে অকার্যকর করে ফেলে বলে জামায়াত মনে করে।
অবশ্য আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপিও দেখাতে চেয়েছে যে, জামায়াতের সাথে তাদের আগের মতো সম্পর্ক নেই। এই পটভূমি জামায়াত নেতৃত্বের মাঝে আলোচনায় ছিল।
এছাড়া গত মার্চ মাসে জামায়াত নেতাদের সাথে বৈঠকে বিএনপি নেতৃত্ব জানিয়েছে যে, তারা পুরোনো জোটকে কার্যকর না করে অন্যান্য দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করবে।
আমীরের বক্তব্য নিয়ে কী বলছে জামায়াত
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, “ডা: শফিকুর রহমান কোন অবস্থাতেই জোট ছাড়ার কথা বলেন নাই। জোট যে কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করছে না – শুধু এই কথাটাই তিনি তুলে ধরেছেন।”
মি. আকন্দ আরও বলেন, “ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন যে, তাদের (বিএনপি) সাথে আমাদের কথা হয়েছে। সেখানেই আলোচনার প্রেক্ষিতেই তারা (বিএনপি) জানিয়ে দিয়েছেন যে আমরা আর জোট কন্টিনিউ করবো না।
“সামনে যে ইস্যুগুলো আসবে, সেগুলোতে যুগপৎ আন্দোলন হবে। সুতরাং এটা একটা আলোচনা হওয়ার পরই যে বিষয়ে উনারা (বিএনপি জামায়াত নেতারা) একমত হয়েছেন, সেই কথাটাই আমাদের আমির ঘরোয়া বৈঠকে ব্রিফ করেছেন,” বলেন মতিউর রহমান আকন্দ।
বিএনপিতে প্রশ্ন
জামায়তের নেতারা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার পরও তাদের আমীরের বক্তব্য নিয়ে বিএনপি নেতাদের অনেকের নানা প্রশ্ন রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে বিএনপির একাধিক নেতা বিবিসিকে বলেছেন, এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার পেছনের কারণ সম্পর্কে তারা বোঝার চেষ্টা করছেন।
দুই-এক দিনের মধ্যে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এনিয়ে আলোচনায় বসবেন বলেও জানা গেছে।
তবে দীর্ঘ সময় ধরে দুই দলের মধ্যে সম্পর্কে দূরত্ব বেড়েছে।
কিন্তু বিএনপি চাইছে না যে, এখই তাদের পুরোনো শরিক জামায়াত ভিন্ন পথে হাঁটুক।
পুরোনো ২০-দলীয় জোটে বিএনপির পক্ষ থেকে লিয়াজোঁ করেন দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
তিনি স্বীকার করেন, তাদের জোট সেভাবে আর সক্রিয় নেই।
তবে একই সাথে তিনি জামায়াত নেতার বক্তব্য নিয়ে বিশেষ কোন সমস্যা দেখেন না।
“কোভিডসহ বিভিন্ন কারণে ২০-দলীয় জোটের কর্মকাণ্ড কিছুটা শ্লথ হয়েছে।”
বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক
বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, “আমরা ২০-দলীয় জোটেই বৃহত্তর ঐক্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
“সেজন্য আমরা বিভিন্ন দলের সাথে আলোচনা করি। তার আলোকে আমরা যুগপৎ আন্দোলন শুরু করবো। জামায়াতের আমীরের বক্তব্যে সেটাই এসেছে। এখানে আমি কোন সংকট দেখি না,” বলেন মি: খান।
দু’হাজার আঠারো সালের নির্বাচনের আগে থেকেই বিএনপির সাথে জামায়াতের সম্পর্কের টানাপেড়েনের কথা বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে।
তবে এখন তা নতুনভাবে আলোচনায় এলেও জামায়াত বিএনপিকে ছাড়ছে না।
আর ঘনিষ্ট সম্পর্ক দেখাতে না চাইলেও বিএনপি জামায়াতকে ছাড়বে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেছেন, “জামায়াত যেটা বলেছে, তারা বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলন করবে। আবার তারা বলেছে, ২০ দলীয় জোট অকার্যকর। এ বক্তব্য কন্টাডিকটরি এবং কনফিউজিং।”
“একটা কথা আছে যে, গাছেরটাও খাব, তলারটাও কুড়াব।”
নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন নেই। ফলে নির্বাচন করতে তাদের বিএনপির টিকেটেই করতে হবে,” অধ্যাপক চৌধুরী ব্যাখ্যা করেন, “একই সাথে তারা (জামায়াত) বিএনপিকে একটা ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছে।”
তিনি মনে করেন, জামায়াত নেতার বক্তব্য বিএনপি অখুশি হয়নি। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতকে নিয়ে বিএনপিতে একটা অস্বস্তি রয়েছে।
“বিএনপির মধ্যে একদল লোক সবসময় চাইতো যে জামায়াতকে বাদ দিয়েই বিএনপি চলুক।
“কিন্তু আবার বিএনপি সাথে রাখতেও চায়, কারণ রাস্তার আন্দোলনে জামায়াত পটু,” বলেন দিলারা চৌধুরী।
বিএনপি এবং জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে।
দু’হাজার নয় সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এটি ২০-দলীয় জোটে রূপ নিয়েছিল।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।