সিবিএন ডেস্ক:
নাম তার খান তালাত মাহমুদ রাফি। পড়ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতিও তিনি। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন সংরক্ষিত কোটাতেই৷ অথচ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেই রাফিই! চট্টগ্রামের সহসমন্বয়কের পদে রয়েছেন তিনি। ফলে তার নেপথ্যে সরকারবিরোধী কেউ আছে কিনা—প্রশ্ন ওঠেছে। রাফির সহপাঠির অনেকেরই দাবি—আন্দোলন করে ‘পকেট ভরছে’ তার।

এদিকে রবিবার (১৪ জুলাই) দিবাগত মধ্যরাতে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে ওই রাফির নেতৃত্বেই আন্দোলনকারীরা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ ‘চেয়েছিলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার’—এমন নানান বিতর্কিত স্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিতর্কিত স্লোগানে কোটাবিরোধী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ এর কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক বেদারুল আলম বেদার বলেন, ’মেধাবী হলে নিজেকে রাজাকার দাবি করে উল্লাস করা যায়, ততটুকু মেধাবী হওয়ার প্রয়োজন আছে কী? কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের মধ‍্যরাতের বিতর্কিত স্লোগানে বেরিয়ে এলো কোটা আন্দোলনের আসল কালো বিড়াল। আন্দোলনকারীরা আসলেই কী চায়!’

তবে ছেলের কোটাবিরোধী আন্দোলনে যাওয়ায় নিজে ‘লজ্জিত’ এবং এটি একটি ‘অপকর্ম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন রাফির বাবা। খান তালাত মাহমুদ রাফির বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। তার বাবার নাম তরিকুল ইসলাম চন্দন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাফির এক সহপাঠী বলেছেন, হয়তো কোটার সংস্কারের দাবিতে এই আন্দোলনে অনেক ‘মজা’ আছে। যার কারণে সে হঠাৎ করেই এ আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া সত্ত্বেও সামিল হয়েছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জামায়াত শিবিরের কেউ তার ‘পকেট ভরিয়েছেন’ মনে হচ্ছে।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় রাফির বাবার দেওয়া একটি বক্তব্য। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাথে কথা বলার সময় রাফির বাবা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসেবে ভর্তি হয়ে এখন আবার চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিতা করে আমার ছেলে আন্দোলন করায় আমি তার বাবা হিসেবে লজ্জিত ও দুঃখ প্রকাশ করছি। নিশ্চয়ই এটি একটি অপকর্ম। এই অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রশাসন যে ব্যবস্থা নেয় তাতে আমি একমত আছি। ছেলে এই ধরনের কাজে জড়িত হওয়ায় আমি নিন্দা প্রকাশ করছি।’

রাফির দাবি, এই আন্দোলন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নয়, এই আন্দোলন ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কারের দাবিতে। তিনি সিভয়েস২৪’কে বলেন, আমার বাবা খুবই সরল-সোজা মানুষ। বাবাকে আমার চেয়ে ভালো কেউ চেনে না। আমার বাবাকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। একটি চক্রান্তকারী মহল আব্বুকে বোঝাচ্ছে, এটি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু এ আন্দোলন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতি। সেক্ষেত্রে এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। কিন্তু আমাদের আন্দোলন ৫৬ শতাংশ কোটার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে।

বাবাকে চাপ প্রয়োগ করে বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে অভিযোগ করে রাফি বলেন, ‘আমার বাবাকে ফোন করে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। জোর করে বিভিন্ন কথা বলানো হচ্ছে। আব্বুর কাছে বলা ছাড়া আর কোনো অপশন ছিলো না। যারা ফোন করে এভাবে হুমকি দিচ্ছে তারা আল্টিমেটাম দিচ্ছে যে, আপনার ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে না আসলে অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হবে। একটা স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার পরিপন্থী কাজ কেউ করতে পারে না।’

এদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ বলেছেন, ‘এটা সারা দেশের ছাত্র সমাজের আন্দোলন। এখানে সবাই যোগদান করবে। এখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই আন্দোলন করছে। তবে কেউ সমর্থন দিলে সেটা তাদের ব্যক্তিগত কিংবা দলীয় ব্যাপার। তাদের সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা নেই।’

উল্লেখ্য, এবার কোটা আন্দোলনের সূচনা হয় গত ৫ জুন হাইকোর্ট ২০১৮ সালের সরকারি পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায় দেয়ার পর। ২০১৮ সালে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সবরকম কোটা পদ্ধতি বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করেছিল সরকার। শুরুতে কোটা বাতিলের পরিপত্র বহালসহ চার দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদমুখর হয়। জুলাই মাসের শুরু থেকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ডাক দিয়ে লাগাতার আন্দোলনে যায় শিক্ষার্থীরা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কোটা নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এমন বক্তব্য আসার পর ছাত্র আন্দোলন একদফার আন্দোলনে রূপ নেয়। আদালত নয় বরং সংসদে আইন পাশের মাধ্যমে সরকারি চাকরির সকল ক্যাডারে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন এসব শিক্ষার্থী।

সবশেষ, রবিবার চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের নেতারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে নতুন ঘোষিত এক দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণপদযাত্রা কর্মসূচি করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। একইসাথে তারা দাবি বাস্তবায়নে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন।

এরই মধ্যে রবিবার দিবাগত মধ্যরাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা বিতর্কিত স্লোগান দেন আন্দোলনকারীরা। এসব স্লোগান নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। তাদের আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। -সিভয়েস২৪