যুগান্তর:
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে রেখে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে বিএনপি। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে সাজানো হচ্ছে এসব পরিকল্পনা। এর মধ্যে জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্র গঠনে জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ইস্যুকে ট্রাম্পকার্ড হিসাবে সামনে আনবে দলটি। ক্ষমতায় গেলে রাজপথের সব দল নিয়ে গঠন করা হবে জাতীয় সরকার। বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ইস্যুতে জনমত তৈরির জন্য নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিভাগীয় পর্যায়ের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে শুরু হয়েছে মতবিনিময়। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় আয়োজন করা হবে বড় পরিসরে। এ দুটি ইস্যুকে ইশতেহারে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরবে দলটি। আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলন ও ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কী করতে চায় তার একটি সারসংক্ষেপ জাতির সামনে তুলে ধরবে বিএনপি।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি শুধুই ক্ষমতার পালাবদল চায় না, বরং রাষ্ট্রকাঠামোতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে আমরা কী করব সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কাছে একটা বার্তা দিতে চাই। প্রতিহিংসা নয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দর একটি দেশ গঠনই তাদের মূল লক্ষ্য। শুধু জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টেই নয়, সবার মত নিয়ে দেশের শাসন ব্যবস্থায়ও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে চায় দলটি।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’তে এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। তিনি (খালেদা জিয়া) বলেছিলেন, আমাদের দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দরকার। সেটাকে সামনে এনেছেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি (তারেক রহমান) বিশ্বাস করেন, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনে নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার প্রয়োজন। ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রয়োজন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট।

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও এমন দাবি তোলা হচ্ছে। দেশ এবং জনগণের কথা চিন্তা করে আমরা এ দাবি উত্থাপন করছি। এটা নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাব, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করব তারপর তা চূড়ান্ত করা হবে। আশা করি সবাই এটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে। কারণ দেশের সুশাসনের জন্য, ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য আমরা এ পরিবর্তন আনতে চাচ্ছি।

বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে একটা বৃহত্তর ঐক্য গঠন প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ২২টি দলের সঙ্গে তারা সংলাপ করেছেন। এসব দলের অনেকেই জাতীয় সরকার, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারা প্রস্তাবগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে কিনা তা নিশ্চিত হতে চাচ্ছে দলগুলো। আমরা ইতোমধ্যে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি। তারাও আশ্বস্ত হয়েছেন। তাই বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব বা শর্ত যাই বলি তা নিয়ে কোনো বাধার সৃষ্টি হবে না।

সূত্র জানায়, দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনেরও ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। একটি কক্ষ বর্তমানে যেভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সেভাবেই হবে। অপরটি কীভাবে হবে তা আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে। দলের গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি সিদ্ধান্তে জনমত তৈরিতে কাজ শুরু করেছে দলটি। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, এ লক্ষ্যে লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে শুরু হয়েছে মতবিনিময়। বিএনপির মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে আট বিভাগীয় শহরে এ সেমিনারের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর সিলেট বিভাগে সেমিনারের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এ প্রক্রিয়া। ১৭ সেপ্টেম্বর রংপুর, ২৪ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পরবর্তী সেমিনার হবে। এছাড়া ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ, ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম, ১৫ অক্টোবর বরিশাল, ২২ অক্টোবর খুলনা ও ২৯ অক্টোবর ঢাকা বিভাগে অনুষ্ঠিত হবে এ সেমিনার।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ-সদস্য জহির উদ্দিন স্বপনের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, সবার সম্মিলিত আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে। আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দল নিয়ে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি রূপরেখা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা করেছেন। এই রূপরেখায় জবাবদিহিতা নিশ্চিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন হলে দেশে যেমন সুশাসন নিশ্চিত হবে, তেমনি দেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। এজন্য দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। তাই আমরা একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বিএনপির এ উদ্যোগ দেশপ্রেমিক জনগণ ইতিবাচকভাবে নেবে বলে আমরা আশা করি।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের যৌক্তিকতা তুলে ধরে দলের এক নেতা জানান, পৃথিবীর উন্নত ও অনুসরণযোগ্য অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রচলন আছে। এর মূল কার্যকারিতা হচ্ছে, দুই স্তরবিশিষ্ট আইনসভায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন করা হয়। বিপরীতে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু ক্ষমতাসীন দলের কার‌্যাবলির পক্ষে একটি রাবার স্ট্যাম্পরূপে ব্যবহৃত হয়। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের এককেন্দ্রিক শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার অন্যতম উৎসস্থল হচ্ছে এই এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর অপ্রতিরোধ্য নির্বাহী ক্ষমতার বলয় ভেঙে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার কোনো বিকল্প নেই। সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত উভয় ব্যবস্থাতেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা বর্তমানে একটি মৌলিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য-সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী যুগান্তরকে বলেন, যারাই ক্ষমতায় যায় তারা দেশটাকে একদলীয়ভাবে শাসন করে থাকে। এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। সেজন্য আমরা নির্বাচন-পরবর্তী জাতীয় সরকার ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলছি। এটা কার্যকর হলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে।

তিনি বলেন, মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে আমরা এ ইস্যুতে বিভাগীয় শহরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছি। সবার মতামত নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা দলের হাইকমান্ডের কাছে জমা দেওয়া হবে। হাইকমান্ড সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।