বাংলা ট্রিবিউন:
ফিলিস্তিনে যখন এক হামলায় হাসপাতালে ৫শ’ মানুষ নিহত হলেন, যখন সীমান্তে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে লাখো বিপর্যস্ত নারী ও শিশু—তখনও পশ্চিমা গণমাধ্যম দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। বিস্মিত হতে হয় ইসরায়েলের পক্ষে তাদের প্রচার-প্রপাগান্ডা দেখে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, এদিকে চলমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের একতরফা প্রতিবেদনে হতবাক ও ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাবিদরাও। তাদের ক্ষোভের কারণ, গণমাধ্যমগুলো কেবল ইসরায়েলের বয়ান তুলে ধরছে। সেসব প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনের কথা নেই। এসব নিয়ে প্রায় ৩১৩ শিক্ষাবিদ পশ্চিমা গণমাধ্যমের উদ্দেশে একটি খোলাচিঠিও লিখেছেন।
প্রশ্ন হলো, যেসব রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ও যারা মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়, তাদের গণমাধ্যম একটি যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারছে না। পশ্চিমের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া দেখলে ইসরায়েলের অত্যাচারের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না বলেই গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন—এই যদি হয় পরিস্থিতি, তবে তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে কোন মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার কথা শেখায়।
কারা এই শিক্ষক? অথবা শাসায়, তারা কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে নেই। এই দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের ওপর হওয়া জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন না। সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে যারা বিবৃতি দিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। এবং তাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত। এই চিঠির অন্যতম স্বাক্ষরকারী ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক ইভলিন আলসুলতানি ১৭ অক্টোবর তার এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) চিঠিটি শেয়ার করেছেন।
চিঠির শুরুতেই নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে শিক্ষকরা লিখেছেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল স্টাডিজ বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে আমরা যারা কাজ করছি, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে আলোকিত করছি, বেশিরভাগ মার্কিন মুদ্রণ-সম্প্রচারমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদের পরিবেশন দেখে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। পশ্চিমা গণমাধ্যমের একপেশে চেহারা ও মিথ্যাচারকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধে ইসরায়েল’—এমন বড় শিরোনাম দিয়ে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন সংবাদ প্রকাশ করেছে, যাতে গাজাকে দৃশ্যপট থেকে মুছে দিয়ে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গিকে ঢালাওভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা সংঘাত নিয়ে ইসরায়েলের বয়ান ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে যাচ্ছে। সাংবাদিকতার নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তারা বলেন—আশা করি, আপনারাও আমাদের মতো বিশ্বাস করেন, সাংবাদিকতার সবচেয়ে পরিশীলিত রূপটি হচ্ছে—সবসময় যেকোনও ঘটনায় সন্দেহপ্রবণ থেকে যাচাই-বাছাই করে সঠিক খবর নিঃসংকোচে পরিবেশন করা। যেকোনও নেতিবাচক ঘটনার সমালোচনা করে যাওয়া, বিশেষ করে প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গি ও নিশ্চুপতার প্রতি প্রশ্ন তুলে তারা বলেন, আপনাদের সন্দেহ করার মতো সেই দৃষ্টিভঙ্গি আজ কোথায়। কেন আমরা গাজায় যুদ্ধাপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের প্রচারিত বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দাবিকে প্রশ্নের মুখে ফেলছি না? যুদ্ধে সাংবাদিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে যুদ্ধের ডামাডোল আরও বাড়িয়ে না তুলে শিগগিরই এসব বন্ধ করা। কারণ, এভাবে চলতে থাকলে সব পক্ষের জন্য গণবিধ্বংসী যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আপনাদের ১১ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সহকর্মীকে ইসরায়েলিরা হত্যা করেছে।
কোনও ইস্যুকে ধরে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর পক্ষপাতিত্ব ও অর্থের বিনিময়ে এজেন্ডা বাস্তবায়নের নজির বহু পুরোনো। এই চিঠি প্রমাণ করে যে পশ্চিমা গণমাধ্যমের আচরণে পশ্চিমা জনগণই ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত।
যে পশ্চিম সবসময় মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার কথা বলে, তাদের গণমাধ্যমে একপাক্ষিক সংবাদ উপস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ যার হাতে তার পলিসিই সেই মিডিয়ার পলিসি। কোন দেশের ছোট পরিসরের গণমাধ্যম কোন দলের নিয়ন্ত্রণে সেই আলাপ হয়, বৈশ্বিকভাবে বড় পরিসরে সেটা কেউ ইসরায়েল কেউ হামাসের পক্ষে কথা বলছে, এভাবেই দেখতে হবে। আমি মনে করি, মাঠের প্রতিবেদক সবসময় সঠিক তথ্যটা দেন। কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণ করে তার নিউজরুম ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের মালিকানা যার, তিনি। বিবিসি যখন এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করবে, তখন তার সরকারের বাইরে গিয়ে অবস্থান নিতে পারবে না। সিএনএন-এর ওপর সরকারের মালিকানা না থাকলেও যে বড় ব্যবসায়ীরা এটার অর্থায়নে আছে, তারা সরকারের অবস্থানের বাইরে যাবে না। ফলে কোথাও না কোথাও মিডিয়া শৃঙ্খলিত।’
মিডিয়া পক্ষে না বিপক্ষে সেই আলাপের চেয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের দর্শনটা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি উল্লেখ করে গ্লোবাল টেলিভিশনের নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘পশ্চিমা মিডিয়া এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে একটা কমন ন্যারেটিভ তৈরি করে নেয়—গণতন্ত্র ও সুশাসনের দর্শন। সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে তারা ফিলিস্তিনের সমস্যাটাকে দেখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ স্বার্থ ঠিক থাকলেই খুশি। ফলে তারা হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখলেও ইসরায়েল কী করছে, সেদিকে নজর দেয় না। ফিলিস্তিনে যে মানুষের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটা তাদের এজেন্ডা না। ফলে সেই জিনিস যখন গণমাধ্যমগুলো চিত্রিত করছে, তখন বলাই যায়— পশ্চিমা গণমাধ্যম মনস্তাত্ত্বিকভাবে স্বাধীন না।’
এবারের হামলার পরে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, ‘গত ১৬-১৭ দিনের তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। পশ্চিমা গণমাধ্যম সবসময় সাংবাদিকতার মান নির্ধারণ করে দিতে চেয়েছে। সেটা করতে গিয়ে তারা বস্তুনিষ্ঠতার কথা বলে। কিন্তু এবারের হামলার পর থেকে তারা একপাক্ষিকভাবে কথা বলেছে। তারা রিপোর্টে ভারসাম্যের কথা বলে, কিন্তু গণমাধ্যমগুলো সেটা রক্ষা করতে পারেনি। এবং যখন কিনা দুইপক্ষেই ভিকটিম আছে তখন কেবল একপক্ষের স্বর তুলে আনতে দেখা গেছে। তারা সংবাদে যে সোর্স ব্যবহার করছে সেটাও গ্রহণযোগ্য না। এমনকি তারা এ সময়টাতে যুদ্ধবিরতির জন্য এজেন্ডা সেট করার কোনও উদ্যোগ নেয়নি, যেটা চাইলেই শুরু করতে পারতো।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।