– কাফি আনোয়ার
ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঈদগাঁও সবসময় যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আনপ্রেডিক্টেবল।একথা সর্বযুগে সর্বকালে সর্বজনবিদিত।
প্রাকপাক আমল থেকে এই অঞ্চলের গণমানুষের মাঝে পাকপ্রীতি কিংবা পাক মোহাব্বত স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০বছরেও কমেনি। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের শেকড় বেশ নাদুসনুদুস এবং শক্তপোক্ত।
বিত্তে বৈভবে, প্রভাবেপ্রতাপে, পাওয়ার এক্সেসাইজিংয়ে সেই সকল দেশ ও স্বাধীনতাবিরোধী পাকপ্রেমী আশেকানদের খাজানা বা নজরানা যুগেযুগে ফোলেফেঁপে বড় হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়।
নানা ঘাতপ্রতিঘাত ও বিরুদ্ধপ্রতিবেশে বাংলাদেশ আ’লীগের বিকাশ জাতীয় রাজনৈতিকচরিত্রের মত এই অঞ্চলেও বারবার যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি হয়েছে লক্ষ্যচ্যুত।
বৃহৎ এই জনপদের মাটি ও মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সঠিক নেতৃত্বের অভাবে বারবার পর্যদুস্ত হয়েছে।
পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক বলয় ভেঙে যখন একটি স্বকীয় ধারায় ঈদগাঁও আওয়ামী লীগ প্রবাহিত হওয়ার চেষ্টা বারবার হোঁচট খেয়েছে।
আবার যখন ধুলিবালি মুছে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে ফের স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলতার রাজনৈতিকচরিত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুল্যবোধকে গ্রাস করেছে অবলীলায়।
সামন্তবাদিচরিত্র আর প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের খাসলৎ যেন ঐতিহাসিকভাবে দাসখত দিয়ে আ’লীগের নীতি আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উপর প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
একটি অঞ্চলে এই যখন একটি দলের দলগত শীলন আর অনুশীলন, তখন চরম হতাশা আর নৈরাজ্যের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে দলঅন্তঃপ্রাণ মুজিবপ্রেমী, মুক্তিযুদ্ধের মুল্যবোধের পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠা তৃণমূল নেতাকর্মীদের সমস্ত আবেগ, ভালবাসা আর ত্যাগের মহিমা।
উপজেলা হিসেবে ঘোষিত হওয়া ঈদগাঁও প্রাচীন “নয়াবাদ” অঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক অপভ্রংশ হলেও এটি আবহমানকাল থেকেই সমৃদ্ধ একটি জনপদ। কৃষি,মৎস্য, লবণশিল্প,বনজ সম্পদ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা,প্রাচূর্য,সম্প্রীতি,সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববোধ,সংহতি অতিথিপরায়ণতা ইত্যাদি কারণে এই ঈদগাঁও ছিল “অনন্য স্বকীয়তায় প্রোজ্জ্বল এক বাতিঘর”।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি অনিবার্য হয়ে উঠা রাজনৈতিক সংগঠনের বিকেন্দ্রীকরণে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নবগঠিত উপজেলা ইউনিট ইতিহাসের অনেক দায় বহন করে।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, সেই দায় মেটাতে গিয়ে খাপছাড়া তলোয়ারের মত উদ্ধত ঔদ্ধত্যে, সংকীর্ণচেতনার বাতাবরণে ঢাকা পড়ে গেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া এই সংগঠনটির আদর্শিক চরিত্র।
পথভোলা উদ্ভ্রান্ত পথিকের মত লক্ষ্যহীন লক্ষ্যে হেলে দোলে দোলছে নৌকাখানি। দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটি অভ্যন্তরে তৈরী হয়েছে একধরণের লুটেরাচরিত্র। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অধিকাংশ নেতানেত্রিদের অস্থিমজ্জায় আছর ফেলেছে।
যে কারণে দলের নেতৃত্ব অর্জন হয়ে উঠেছে বিনিয়োগের সবচেয়ে নিরাপদ ও লাভজনক ক্ষেত্র। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলা সর্বক্ষেত্রেই এই সত্য দলের অশনিসংকেত হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।
হালআমলে নেতৃত্ব বাছাইয়ের গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অন্তঃসারশুণ্যতাকে প্রমাণ করছে বারবার।
ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা পর্যন্ত কাউন্সিলর তালিকাকেন্দ্রিক বিতর্ক তৃণমূলের হতাশাকে একদিকে যেমন দীর্ঘশ্বাসে পরিণত করছে, অন্যদিকে প্রতিটি স্তরে কাউন্সিলর বেচাকেনায় বিপুল অর্থশক্তির বিনিয়োগ ও ব্যবহার প্রকৃত দলীয় চেতনা ও আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করছে।
ওয়ার্ড পর্যায় থেকে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে আসছে প্রত্যেক প্রার্থীকে ব্যয় করতে হয়েছে ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা।যা ইউনিয়ন পর্যায়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা।আবার উপজেলা পর্যায়ে এই মিশনের আনুমানিক ব্যয় ১ থেকে দেড় কোটি টাকা। অর্থশক্তি ব্যবহারে যিনি যত শক্তিমান নেতা হওয়ার দৌঁড়ে তিনি তত বেশী সম্ভাবনাময়ী।
এই চিত্র ঈদগাঁও উপজেলা’সহ কক্সবাজার জেলার প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা অবদি অনেকটা ওপেনসিক্রেট।
তৃণমুলের ত্যাগী ও দুর্দিনের কর্মীদের অভিযোগ, কাউন্সিলর তালিকায় তারা অপাঙতেয়, অচ্ছুৎ ও ব্রাত্য।
কাউন্সিলর তালিকা গঠনের ক্ষেত্রে নেতারা অনেকটা গ্রীকপুরাণের একচক্ষুদানব সাইক্লোপসের দৌরাত্মে দুষ্ট। ১৬ঃ১৫ এই অনুপাতে সৃষ্ট কাউন্সিলর তালিকায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মর্জি ও এনার্জিতে যুক্ত হয়েছে পদলেহন ও লেজুবৃত্তিবাদিতা,চামচামিপণা,ভ্রাতৃত্বকরণ,আত্নীয়করণ,জামায়াতিকরণ,রাজাকারায়ণ, শ্বাশুরালয়করণ,স্বার্থবাদি আনুগত্যায়ণ ও পদ বাণিজ্যকরণের মত শতশত অপশিষ্ট ও অপরাজনৈতিক সংযুক্তি।
যা উপমহাদেশের বৃহৎ ও প্রাচীণ রাজনৈতিক দলটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও মান-মর্যাদাকে সস্তা ও মূল্যহীন লোকরঞ্জনবাদি আদর্শের প্রতিভূতে পরিণত করেছে।
অন্যদিকে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থান’সহ দলের এবং সরকারের সকল অর্জন ও সফলতা মলিন ও বুমেরাং হওয়ার পাশাপাশি দলের নেতৃত্বের সাথে সাধারণ মানুষের দুরত্ব বাড়ছে দিন দিন।
দুঃসময়ের কান্ডারী, নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের অবমুল্যায়ণে দলের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা অসন্তোষ, অনৈক্য ও হতাশা বিস্ফোরন্মুখ।
এখানেই শেষ নয়,অতীতে দলের ত্রাতা বা দুর্দিনের কাণ্ডারী বলে বিবেচিত কক্সবাজার সদর উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা এসটিএম রাজা মিয়া ও আলমগীর চৌধুরী হিরু, একসময়ের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও ঈদগাঁও ইউনিয়ন আ’লীগের সহ- সভাপতি অকালপ্রয়াত
আবু তাহের চৌধুরীর মত নেতাদের মূল্যায়ণ কিংবা মৃত্যু পরবর্তী কোন শোকসভা বা স্মরণসভা কিংবা একটি শোকবিবৃতি দেয়ার মত কোন উদ্যোগ বা শ্রদ্ধাবোধ বিগত দিনে দেখা মেলেনি। জামায়াত শিবিরচক্রের হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে খুন হওয়া কক্সবাজার উত্তর থানা (পরবর্তীতে ঈদগাঁও সাংগঠনিক উপজেলা) ছাত্রলীগের কর্মী শহীদ এরশাদের বিচারের বাণী গত ২১টি বছর শুধু নীরবে নিভৃতে কাদঁছে।
দল ও দলের অভ্যন্তরে দিনে দিনে বেড়েছে হালুয়া রুটি ভাগের ভাগদার, গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের আড়ালে বিকশিত হয়েছে ধনতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, বেড়েছে ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী কাক আর কোকিল, পারষ্পারিক অশ্রদ্ধা ও জিঘাংসা,লেঙ মারামারির সংস্কৃতি, স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের সাথে গোপন আতাঁত ও তাদের পৃষ্টপোষকতা প্রদানের উদ্ভট ও উৎকট প্রতিযোগিতা।
ছলেবলেকৌশলে কিংবা ম্যাকেয়াভ্যালীর তত্ত্ব অনুকরণে, অর্থভাণ্ডারের অসম ও সুষম লগ্নিকরণে ,আতাঁতে, কোরাণস্পর্শী অর্থপ্রদান ও ভোটদানের নিশ্চিতকরণ শপথের বাধ্যবাধকতায় কাউন্সিল নামীয় দলীয় গণতান্ত্রিক বৈতরণী পার হওয়াই যেন সকলের প্রধান ও একমাত্র মোকামে মঞ্জিল । নৌকা ডুবুক কিংবা অথৈ সাগরে ভাসুক, জাহান্নামে যাক দলীয় নীতিআদর্শ, উচ্ছন্নে কিংবা প্রচ্ছন্নে ভূপাতিত হোক মহান নেতার আদর্শ কার কি আসে কিংবা যায়। টাকাই যেন রাম রাম সত্য নাম। নেতৃত্বের মোড়কে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ এটাই চিরায়ত অপ্রিয় এক সত্য।
সারাদেশের এমন হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে সময় এসেছে দলের গঠনতন্ত্র পুনঃমুল্যায়ণের মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সংশোধনের।
দলের সকল সাধারণ সদস্যকে কাউন্সিলর ধরে এবং প্রত্যেকে প্রতি স্তরে ২ টি করে মোট ভোটপ্রদানের ক্ষমতা নিশ্চিত করে একই দিনে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলার কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রতিটি স্তরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক( ২জনকে মোট ৬ জন) নির্বাচন করলে বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভবপর হতো। এই ধারণার সাথে তৃণমূল আ’লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী ঐকমত পোষণ করে। আসন্ন কেন্দ্রিয় কাউন্সিলে এই প্রস্তাবনাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে সংশোধনী প্রস্তাব আকারে উপস্থাপনের মাধ্যমে পাশ করে নেয়ার দাবী অনেকের।
এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে অনতিক্রম্য বাস্তবতায় দলগত ক্রান্তিতে ঈদগাঁও উপজেলা আ’লীগের সম্মেলন ও কাউন্সিলে কুরুক্ষেত্রের মত “ধর্মের জয়, অধর্মের বিনাশে” জয় হোক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।