• বদরুল ইসলাম বাদল

ভৌগোলিক অবস্থান গত কারণে বাংলাদেশে এখন শীত মৌসুম।হিমশীতল বায়ু প্রবাহিত হয়ে শীতের জানান দিচ্ছে প্রকৃতি। কুয়াশায় গোমড়া ডাকা প্রকৃতির অপরুপ সাজ। এই সময়ে গোলাপ, বেলী, গাদা, বকুল, চামেলি ফুলের সৌন্দর্য ফুটে উঠে শীতের ছোঁয়ায়।দূর্বাঘাসের মাথার উপর জমে থাকা শিশির বিন্দুর উপর সূর্যের আলো মোহনীয় সৌন্দর্যের আমেজ সৃষ্টি করে।মাঠের পর মাঠ সর্ষে ফুলের রুপ বিমোহিত করে বাংলার আউল বাউল কবি মন । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এদেশ যেন দক্ষ কারুশিল্পীর হাতের আঁকা একটি জীবন্ত ছবি।এদেশে ভিন্ন ভিন্ন রুপ নিয়ে বৈচিত্র্য সাজে সজ্জিত হয়ে আবর্তিত হয় ছয়টি ঋতু।পাহাড় নদী, ঝর্ণা , সমুদ্র সৈকত,সবুজ গাছগাছালি, ফুল. ফলে ভরা প্রকৃতি প্রেমী ভ্রমণ পিপাসুদের পছন্দের দেশ। রবি ঠাকুরের সোনার বাংলা। বিদ্রোহী কবির বাংলাদেশ।আর কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার অপরুপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তার “রুপসী বাংলা” কবিতায় লিখেন, “বাংলার রুপ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর অন্য কোন রুপ দেখিতে চাই না আর”।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এইজনপদের মানুষ দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, শোষণ এবং লুন্ঠনের কারণে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য সংগ্রাম করে সুদীর্ঘ সময় ধরে।একাত্তরের রক্তঝরা স্বাধীনতা পাওয়ার পরও কৃষক শ্রমিক মেহনতী জনতার ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয় নাই। তাই স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু মুজিব শোষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে কৃষকরাজ, শ্রমিকরাজ কায়েমের কর্মসূচি ঘোষণা করেন স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায়। তাতে আঁতে ঘা লাগে পুঁজিবাদী বিশ্বের।এই কর্মসূচি শুরুর উষা লগ্নে শোষিত মানুষের পরম বন্ধু বঙ্গবন্ধু দেশি-বিদেশি চক্রান্তে নির্মম হত্যার স্বীকার হন। ফলে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়ে ও নাগরিকদের সর্বোচ্চ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা যায় নাই।ধনী দরিদ্র মানুষের পরিসংখ্যানের ব্যবধান অনেক। দেশের ধনসম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে।সুবিধাবঞ্চিত মানুষের হাহাকার উদ্বেগ জনক। রাস্তায় ছিন্নমূল হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ দুর্দশার যেন শেষ নাই।মৌসুমে শীত যেন হতদরিদ্র মানুষের জন্য অভিশাপ ।শীতের তান্ডবে তাদের জীবন যাপনের করুণ অবস্থা। কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ঋতু পরিবর্তনের পরিবর্তনশীল প্রকৃতিতে শীতের সময় আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার কালজয়ী “প্রার্থী ” কবিতার মাধ্যমে গরীব অসহায় ছিন্নমুল মানুষের দৈন্য দশা অত্যান্ত নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি লিখেন,
“হে সুর্য তুমি তো জান
আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব
সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে
একটুকরো কাপড়ে কানঢেকে
কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই”।
তিনি ঠিকই বলেছেন, শীতে বেশি কষ্ট পায় আশ্রয়হীন সম্বলহীন শীত বস্ত্রহীন দরিদ্র মানুষ। যাদের অনেকের বসবাস ফুটপাত, ষ্টেশন কিংবা প্রত্যয়ান্ত গ্রামাঞ্চলে।যাদের দুবেলা খাবার জোগাঢ করতে হিমশিম খেতে হয়। পুষ্টিহীনতায় ভোগে।শীতের গরম কাপড় কেনার টাকা থাকে না। অনেকের খোলা আকাশের নিচে বসবাস। আর তাই শীতকাল অসহায় মানুষের জন্য এক ধরনের অভিশাপ। অনেক কষ্টের। অন্য দিকে শীত মৌসুম ধনীদের জন্য সুখের, আনন্দের, উপভোগের এবং,বিলাসিতার ও বটে। আগেকার দিনে শীত নিবারণে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে শীতের সকালে ছেলে বুড়ো সবাই এক সাথে মিলে আগুন পোহাত, আনন্দ উল্লাসের সাথে ।ধানের জমিন থেকে ধান তুলে নেবার পর ধান গাছের অবশিষ্টাংশ পড়ে থাকে জমিতে,এগুলো নাড়া হিসেবে পরিচিত। রোদে পুড়ে সে নাড়া শুকিয়ে গেলে গ্রামের ছেলে মেয়েরা ঐ গুলি সংগ্রহ করে ।শীত মৌসুমে সাতসকালে ছেলে মেয়েরা ঐ নাড়া দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে পোহায়,শীত দুর করে। যাহা গ্রামীণ জনপদের সংস্কৃতি হিসেবে অনেক দিন হতে চলে আসছে। কিন্তু আজকের পরিবর্তনশীল দৃশ্যপটে সে চিত্র গুলো আর দেখা যায় না তেমন ।অন্য দিকে শহরের বিভিন্ন বস্তিতে, ষ্টেশন কিংবা ফুটপাতে কাঠ-খড় পুড়িয়ে শীত তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে কিছু ছিন্নমুল মানুষ,তবে যার সংখ্যা খুবই নগন্য।

আবহাওয়া অফিস সুত্র মতে , চলতি মাসে এবং ফেব্রুয়ারিতে ও শৈত্য প্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে ।যা শীত বস্ত্রহীন দরিদ্র মানুষের জন্য একটি দুঃসংবাদ। তাই সমাজের যারা বিত্তশালী তারা হতদরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। সরকার মাঝে মধ্যে কিছু শীতের কাপড় বিতরণ করলে ও প্রয়োজনের তুলনায় যা অপ্রতুল। তাই ব্যক্তিপর্যায়ে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিককে দু-এক জন করে গরীব মানুষের কাছে শীতবস্ত্র দিতে এগিয়ে আসা দরকার ।সুপরিচিত নোবেলজয়ী সমাজসেবক মাদার থেরেসার ভাষায়,” যদি তোমার একশো মানুষের সাহায্য করার সক্ষমতা না হয়,তাহলে অন্তত একজনকে সাহায্য করো”।তাই বলা যেতে পারে শীতে কষ্ট পাওয়া মানুষের পাশে থাকার জন্য বড় লোক পয়সাওয়ালা হতে হবে এমন কোন কথা নাই। কারও ঘরে পুরনো কাপড় আছে কিংবা ব্যবহারের অতিরিক্ত কাপড় পড়ে আছে,সে গুলো দুই একজন সহায়হীন মানুষকে দেয়া যায়। ।হাত খরচের টাকা থেকে টাকা বাচিয়ে ও কয়েক জন দরিদ্র ছিন্নমুল মানুষের পাশে দাড়ানো যায়।প্রত্যেকে নিজের অবস্থান থেকে কিছু না কিছু মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্রহীন দরিদ্র মানুষের পাশে দাড়ানো হলে সম্মিলিত মানুষের মানবতার কাছে শীত পরাজিত হয়ে যাবে।

কক্সবাজার জেলা পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত। তবে এখন সে পরিচয় চাপিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শরনার্থী জেলা হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ও তাই। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে কক্সবাজারের জনসাধারণ বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন।দেশী কিংবা বিদেশি সংস্থা এবং দাতাগোষ্ঠী সব সময় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করে থাকে, নজর রাখে।যেন মনে হয় কক্সবাজারে কোন গরীব, অসহায় ছিন্ন মুল মানুষ নাই। সবাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে মানবতার ফেরিওয়ালা সাজতে চায়।কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের ভরনপোষণ খাওয়া দাওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব দায়বদ্ধ। প্রতিবেশী হিসেবে শুধু আমরা জায়গা দিয়েছি। যার কারণে নিজের দেশে কক্সবাজারবাসী যেন আজকের দিনে পরবাসী।কক্সবাজারে যেন দরিদ্র মানুষ নাই,রাস্তা ঘাটে পথে প্রান্তে যেন ভাসমান সুবিধা বঞ্চিত মানুষের বড় অভাব।তাই সবাই ছুটে যায় রোহিঙ্গাদের দিকে। ফলে উপেক্ষিত হয় কক্সবাজারের ছিন্ন মুল সুবিধা বঞ্চিত মানুষ। তাই দেশী-বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর কক্সবাজারের হতদরিদ্র মানুষের পাশে সহযোগিতা করা দরকার বলে মনে করেন বিজ্ঞ সচেতন মহল।কারণ রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন। সামাজিক অর্থনৈতিক যোগাযোগ কিংবা ভিন দেশের মানুষের আনাগোণা কক্সবাজারের উদার রক্ষনশীল সমাজ প্রশ্ন বিদ্ধ। তাই কক্সবাজার জেলার সহায় সম্বলহীন মানুষ সহযোগিতা পাওয়ার অধিকার রাখে।

তবে মনে রাখা ভালো যে,”গরীবদের সাহায্য করার সময় ক্যামরাটা বাসায় রেখে যান।এতে যাকে সাহায্য করছেন সে খোলা মনে নিতে পারবে “(সংগৃহীত)।আজকাল ফেইস বুক সহ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ার বদৌলতে অনেক মানুষ আত্মপ্রচার করতে চায়।আত্মমর্যাদা প্রত্যেক মানুষের সহজাত। গরীব অসহায় মানুষজন ও লাজ লজ্জার উর্ধ্বে নয়।

লেখক – কলামিস্ট, সাবেক ছাত্র নেতা।