-তাওহীদুল ইসলাম নূরী

আমাদের দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েই চলছে। আত্মহত্যা বলতে আমরা নিজেকে নিজে হত্যা করাকে বুঝি। কিন্তু প্রায় সকল ধর্ম মতে, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে পরকালের অনন্তকাল জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন করাই আত্মহত্যা। সকল ধর্মেই এই কাজটি সম্পর্কে সতর্ক বাণী করে এটা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে আত্মহত্যা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। হযরত মোহাম্মদ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করবে তার পূর্ববর্তী সকল আমল নষ্ট হয়ে যাবে এবং আত্নহত্যার শাস্তিস্বরূপ সে অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে পুড়তে থাকবে। ইসলাম ধর্মে এই ঘৃণ্য কাজটিকে এত বেশি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে যে, কোন আলেমকে আত্মহত্যাকারীর জানাযা দিতে নিষেধ করেছেন ইসলাম তথা শান্তির বার্তা বাহক হযরত মোহাম্মদ (স.)। মুসলিম হিসেবে জানাযা পাওয়ার অধিকার আছে তাই রাসুল (স.) আত্মহত্যাকারীর জানাযা দিতে নিষেধ করেন নি। কিন্তু, কোন আলেম যেমন সেই জানাযা পড়াবে না, তেমনি সমাজের গণমান্য মানুষ যাদেরকে অন্য দশজন মানুষ অনুসরণ করে তারাও আত্মহত্যাকারীর জানাযায় শরীক হবেন না। যাতে করে আত্মহত্যার অপরাধবোধ বাকীদের অনুভূতিতে জাগ্রত থাকে। রাসুল (স.) নিজেও তাঁর সামনে এক আত্মহত্যা করা ব্যক্তির লাশ হাজির করলে তিনি ঐ ব্যক্তির জানাযায় অংশ নেন নি।

হিন্দু ধর্মেও আত্নহত্যা সম্পর্কে কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। ঈশ উপনিষদে আত্মহত্যার তীব্র নিন্দা ও সাবধান করে বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি মৃত্যুর পর এক আনন্দহীন ধরায় গমন করে। ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জগৎ যেখানে সামান্যতম আলো পৌঁছায় না সেটাই হবে ওদের অনন্তকালের আবাসস্থল।

আত্মহত্যার ব্যাপারে সবচেয়ে নমনীয়তা দেখা যায় বৌদ্ধ ধর্মে। বৌদ্ধদের বিশ্বাস হচ্ছে, কর্মফল থাকলে মৃত্যু হবেই। কে কীভাবে মরবে সেটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার। আত্নহত্যা পাপ নয়, বরং পাপের ফসলই আত্মহত্যা। কিন্তু, কেউ যদি এই কাজ করতে চায় তাহলে নীরব না থেকে তাকে সাধ্যমত বুঝাতে হবে।

অন্যদিকে খ্রীষ্টান ধর্মেও আত্মহত্যা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। বাইবেল থেকে পাওয়া যায়, স্রষ্টার বিরুদ্ধে করা এক ভয়ানক পাপের নাম আত্মহত্যা। যে আত্মহত্যা করল সে শুধু নিজের যাত্রা নরকের দিকে তরান্বিত করা ছাড়া আর কিছুই করল না।

ইসলাম,হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রীষ্টানসহ সকল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, আত্মহত্যা কখনো শোভনীয় নয়। কোন ধর্মই এই কাজটিকে সমর্থন করে না। সকল ধর্মেই কাজটিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সাধারণত, মানুষ জীবনের অপ্রাপ্তি থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। যদিও সবাই পৃথিবীতে সকলের মাঝে বেঁচে থাকত চায়, কিন্তু যখন নিজের কাছে পৃথিবীটা অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয় তখন মানুষ নিজেকে নিজে শেষ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
দেখা যায় যে, পারিবারিক জটিলতা,আর্থিক সংকট,পড়াশোনা-চাকরী নিয়ে হতাশা, পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি, ব্যক্তি জীবনে নানান অপ্রাপ্তি থেকে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই। ২০২০ সালের ০৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ করোনা মহামারীর প্রথম ঢেউ চলাকালীন সময়ে আত্মহত্যা করেছে দেশের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। যার পরিমাণ ২০১৯ সালের চেয়ে ৪৪.৩৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০২০ সালে যেখানে ৭১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে, সেখানে দেখা যায় ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। অর্থাৎ প্রতি বছর এই সংখ্যা বেড়েই চলছে।

আমাদের সকলের জানা ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে “Life is not a bed of roses” অর্থাৎ জীবন ফুল শয্যার নয়। নানান ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিকূল পরিস্থিতি পার করতে হয় জীবনে। সময় পরিবর্তনশীল। আজকের প্রতিকূল পরিবেশ ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার সহিত মোকাবিলা করতে পারলে কাল নয়তো যে কোন সময় অনুকূলে আসবে। হতাশ হওয়ার আসলে কিছুই নাই। জীবনকে শেষ করা দেয়ার কোন অর্থ হয় না। আলোকময় পৃথিবীটা যখন নিজের কাছে শূন্য মনে হবে আর অন্ধকারাচ্ছন্ন ভেবে নিজেকে আত্মাহুতি দিতে ইচ্ছে করবে, তখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে “আমি আর নিজের জন্য নয়, সমাজ,দেশ এবং মানবতার কল্যাণেই পৃথিবীতে বাকী জীবন অতিবাহিত করে যাব”। কারণ,আত্মহত্যা কখনোই সমাধান নয়।