বদরুল ইসলাম বাদল
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তোরজোড় শুরু হয়ে গেছে।নানাবিধ সমীকরণ, জোট বিজোড়, যোজন বিয়োজন নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক পাড়া। সব দল নিজেদের ঘর গুছানো নিয়ে ব্যস্ত।তার ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীন দলের সম্মেলন এবং কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে চাঙা করার অভিযান চোখে পড়ার মতো। ওয়ার্ড থেকে জেলা সর্বশেষ সর্বোচ্চ ফোরাম পর্যন্ত দল সাজানো নিয়ে কাজ করছে দায়িত্ব প্রাপ্ত সাংগঠনিক টিম।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত সম্মেলন ও কাউন্সিল দলের চলমান প্রক্রিয়া। দলের গঠনতন্ত্র মতে নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কাউন্সিল দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিরই অংশ। যার মাধ্যমে উঠে আসবে নতুন নেতৃত্ব। দলের পদপদবীতে নতুন করে বিন্যাস।
আওয়ামী লীগের কয়েকটি ইউপি সম্মেলনে উপস্থিত থেকে দেখা গেল, সম্মেলন ঘিরে সত্যি সত্যিই নেতা কর্মীদের উত্সাহ উদ্দীপনার শেষ নাই। নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলনের দিনে নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি প্রশংসার দাবি রাখে। সীমিত যোগাযোগ ব্যবস্থায় শহর থেকে কিছুটা দুরত্বে ইউনিয়ন সমূহ।গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দারা প্রায় সবাই ঘর-সংসারের কাজে সদা ব্যস্ত থাকে। তারপর ও সম্মেলনে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি উপজেলা পর্যায়ের মিটিং এর চেয়ে কম বলে মনে হয় না।অনুষ্ঠানের জায়গা চাপিয়ে চারিদিকে ব্যাপক মানুষের ভীড়, মিটিং ঘিরে উত্সাহী মানুষের কৌতুহল,এইরকম রাজনৈতিক সচেতনতা গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো উন্নয়নের জন্য শুভ লক্ষণ।দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ সম্মেলন পাঁচ, দশ বছর, পনের বছর কোথাও আরও বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয় না।ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কিংবা সা; সম্পাদক দিয়ে আবার অনেক জায়গায় দুটোতেই ভারপ্রাপ্ত দিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। সাংগঠনিক কমিটির অন্য পদে কতজন ভারপ্রাপ্ত কিংবা পদ শুন্য আছে তা জানার সুযোগ থাকে না । কথা হল একান্ন সদস্যের কমিটির মাঝে এই দুটো পদই কি শুধু প্রাসঙ্গিক?নাকি পাঁচ দশ কিংবা পনের বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটিতে পদ শুন্য হওয়ার মত কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নাই?কিন্তু গঠনতন্ত্র মতে কমিটির প্রতিজন সদস্য ই গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো একজন পদবীধারী কিংবা সাধারণ সদস্যের শুন্যতায় কমিটি অপুরণ রয়ে যায়। দলের ধারাবাহিক গঠনতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত এবং চর্চার স্বার্থে এই বিষয় টি নজরে রাখা দরকার।
সম্মেলনে নেতাদের বক্তব্যে যে বিষয় টি জোরালো ভাবে উঠে আসছে তা হল রাষ্ট্রক্ষমতা হারানো নিয়ে শঙ্কা, উত্কন্ঠা আর ভীতি।আর ভয় থেকে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার আর্জি এবং অভিমত। সম্মেলনে উপস্থিত একজন আওয়ামী সমর্থক প্রবীণ মুরব্বি মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে এত নেতাকর্মী থাকলে ভয়টা কিসের? তাহলে এত উপস্থিতি কি আওয়ামী লীগের মানুষ নয়?পাশে বসা আরেক প্রবীণ সমর্থক বলে উঠেন,”সবাই আওয়ামী লীগার, কিন্তু স্হানীয় নেতাকেন্দ্রিক বিভক্তিতে কর্মীরা অনেক ভাবে বিভাজিত।একে অন্যদের সাথে রেসারেসি, ল্যাং মারা,অপছন্দের নেতাকে নির্মূল নিয়ে নানা কুঠকৌশল। মঞ্চে একতা এবং ঐক্যবদ্ধতা নিয়ে যতই কথা বলা হয় না কেন, “মুখে শেখ ফরিদ,বগলে ইট”।সমর্থক মুরুব্বিদের কথা শুনে নিজেকে প্রশ্ন করি আসলেই কি তাই?। প্রার্থনা করি মুরুব্বিদের কথা যেন সত্যি না হয়।তবে তাদের মন্তব্য থেকে সবক নেয়ার মতামত রাজনীতিতে অভিজ্ঞ মহলের।তবে কথা থেকে যায়, দলের দায়িত্বশীল নেতৃত্ব নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক অনুশীলন নিয়ে চরম উদাসীন। কিছু হালোয়া রুটির লালস দিয়ে পিছনে ঘুরঘুর করতে রাখে।।তবে যাদের কাছে নীতি নৈতিকতা এবং আদর্শের শিক্ষা নাই রাজনীতি তাদের জন্য নয়। ঘুরঘুর করা হাজার নেতাকর্মী দলের দূর্যোগের সময় কোন কাজে আসবে না। একমাত্র আদর্শিক কর্মীই প্রতিরোধ বলয় গড়ে তুলতে সাহসীকতার পরিচয় রাখবে।কিন্তু বাস্তবতা হল, প্রশিক্ষিত কর্মী সৃষ্টি নিয়ে ব্যর্থ দীর্ঘ সময় সরকারে থাকা ক্ষমতাসীন দল। তাই তো নেতাদের এত ভয়, শঙ্কা।কারণ সত্, ত্যাগী ও আদর্শিক কর্মীর চেয়ে চামচা, ক্যাডার,তেলবাজ,হাইব্রিড সৃষ্টি করেছে প্রচুর। যারা আদর্শিক কর্মী তারা পদপদবীতে না থাকলেও হতাশ হয় না। কারও চামচাগিরি করে না। রাজনৈতিক শিক্ষা বিমুখী সংস্কৃতি তেল মা-রা নিয়ে অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে ।উল্লেখ্য যে,”তেল মারা আর পা চাটা যখন
পেশা হয়ে যায়, তখন সত্ মেধাবী ও যোগ্যরা বঞ্চিত ও অবহেলিত। তখনই সমাজের ভবিষ্যৎ চলে যায় অসত অযোগ্য ও বাট-পাড়দের হাতে”। অর্থ ও চামচামির মাধ্যমে পদ পাওয়া যায়, কিন্তু রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না।
দেখা যাচ্ছে, সম্মেলনে কাউন্সিলার তালিকায় নাম থাকা নিয়ে প্রতিযোগিতা,লবিং,গ্রুপিং।কাউন্সিল ঘিরে টাকার খেলা নিয়ে অনেক কথা হাওয়ায় ভাসছে। প্রার্থীরা গোপনে টাকা দিয়ে কাউন্সিলারদের ম্যানেজ করার অভিযোগ কোথাও ।বিগত ইউপি নির্বাচনে অনেক জায়গায় নৌকা প্রার্থীর চরম লজ্জাজনক পরাজয় আওয়ামী সমালোচকদের মুখে রসদ যোগাচ্ছে।চকরিয়ার কৈয়ারবিল, চিরিঙ্গা, পেকুয়ার মগনামায় নৌকার ভোট শতকের ঘরে এবং কয়েক দিন আগে বড় মহেশখালীতে দুইশোটি শীলমোহর ও নৌকাতে পড়ে নাই।এসব ইউনিয়নে কাউন্সিলার ও সমর্থকের সংখ্যা আরও বেশি,এরা কই?ইউপি নির্বাচনে লীগের কাউন্সিলার সমর্থকদের ভোট কোথায় যায়? এত ভোট কোথায় গেল?অনেক বড় প্রশ্ন।তবে ইলেকশনের পর নৌকার বিপর্যয় নিয়ে ইউনিয়ন কমিটিকে জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরী, অভিমত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিবিদদের। রেওয়াজ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কমিটির পদত্যাগ করা উচিত কিংবা কমিটি বাজেয়াপ্ত করা উচিত।ইউনিয়ন কমিটির নেতা নির্বাচনে দুইশত একান্ন জন কাউন্সিলার ভোট প্রদানের যোগ্যতা অর্জন করে, সেখানে 36 বা 99 কিংবা আরো কম ভোট কিভাবে নৌকায় যায়?সম্মেলনে কাউন্সিলার হওয়ার জন্য লম্বা তালিকা থাকে।এসব অসঙ্গতি উপড়ে না ফেললে সুস্থধারার রাজনীতি চর্চা এবং আদর্শিক কর্মী সৃষ্টির পথে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকবে।ফলে ভয় এবং শঙ্কা রয়েই যাবে।গাজী নাজমুল নামের একজন ফেইসবুকে লিখেন, “সংগঠনে শৃঙ্খলা ও সাংগঠনিক দক্ষতা না থাকলে কমিটি কমেডি হয়ে যায়।দায়বদ্ধতা আসুক,শুভ বুদ্ধির উদয় হোক”।
সম্মেলন হল নবীন প্রবীণ নেতাকর্মীদের মিলনমেলা।কর্মী সমর্থক শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সমাগম ঘটে। রাজনৈতিক আলোচনা শুনবার আকাঙ্খা সবারই। বক্তার সিরিয়াল এত দীর্ঘ হয় যে, দলের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব হয় না,সময়ের অভাবে বক্তাদের। তাই যে নেতৃবৃন্দ কথা সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেন তাদের সময় বেশি রাখা দরকার দাবী উপস্থিত শ্রোতাদের।
আধুনিক রাষ্ট্রবিদগণের অভিমত, নির্বাচনে বিপুল ভাবে জিতলেই একজন নেতা যোগ্য, সফল এবং শক্তিশালী নেতা, সেটা ভুল ধারণা। জয়লাভ হওয়া মানেই কিন্তু ভালো নেতা হওয়া নয়।প্রকৃত রাজনীতিবিদ হতে হলে মানুষের হ্নদয়ে স্থান করে নেয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে”।নির্লোভ নির্মোহ রাজনৈতিক শিক্ষায় মেধাবী নেতৃত্বের বিকাশ রাজনীতির মাঠে দলকে শঙ্কা,উত্কণ্ঠা মুক্ত এবং নিরাপদ রাখতে পারে।তাই জরুরি রাজনৈতিক পাঠ, শিখন, পঠন এবং চর্চা।
জয় বাংলা।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি এবং সাবেক ছাত্রনেতা।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।