শাহেদ মিজান, সিবিএন:
মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউয়িনের দুই পয়েন্টে বেড়িবাঁধের বাইরের বিস্তীর্ণ প্যারাবন কেটে ঘের তৈরি করছে ভূমিদস্যুরা।
ইউয়িনের পানিরছড়া ও মোহরাকাটার পশ্চিমে অমাবশ্যাখালী মৌজা ও কালাগাজির পাড়ার পশ্চিমে বগাচতর ঘোনার পেছনে এই ভয়াবহ ভূমিদস্যুতা চলছে। বনবিভাগের চোখের সামনে প্যারাবনের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলেছে ভূমিদস্যুরা। প্যারাবন কেটে অমাবশ্যাখালী মৌজায় প্রায় ১০০ একর ও বগাচর ঘোনার পশ্চিমে প্রায় ৩০০ একর সরকারি খাস খতিয়ানের জমি দখল করে ঘের তৈরি করা হচ্ছে। সরকারি দল আওয়ামী দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতার নাম ভাঙিয়ে এই পরিবেশ বিধ্বংসী অপকর্ম চালাচ্ছে ভূমিদস্যুরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহরাকাটার সাহাব উদ্দীনের নেতৃত্বে একটি চক্র পানিরছড়া-মোহরাকাটার পশ্চিমে অমাবশ্যা মৌজার বেক্সিমকোর প্রজেক্ট সংলগ্ন বেড়িবাঁধের বাইরে প্রায় ১০০ একর প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের করছে। চক্রটি দুই মাস আগে এই প্যারাবন নিধনযজ্ঞ শুরু করে। শুরুর দিকে দিনদুপুরে প্রতিদিন শতাধিক শ্রমিক নিয়োগ করে কেটে ফেলে প্যারাবনের প্রায় ১০ হাজার গাছ। এরপর স্কেভেটর লাগিয়ে রাতদিন মাটি কেটে ঘেরের বাঁধ তৈরি করে। ইতিমধ্যে এক কিলোমিটারের বেশি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে লবণ চাষও শুরু করেছে। সেখানে একটি খালও বাঁধ দিয়ে আটকে ফেলা হয়েছে।
অন্যদিকে কুতুবদিয়ার (বর্তমানে কক্সবাজার শহরের বাসিন্দা) এরশাদের নেতৃত্বে মতিন, নাজু ও শাহাদাতসহ একটি চক্র ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বগাচতর ঘোনার পশ্চিমে প্যারাবন কেটে ৩০০ একর সরকারি জমির দখলযজ্ঞ শুরু করে। চক্রটি শুরুর তিন দিনে প্রতিদিন দুই শতাধিক শ্রমিক লাগিয়ে প্রায় ২০হাজার গাছ কেটে ফেলে। এরপর চারটি বড় আকারের স্কেভেটর লাগিয়ে শুরু করে বাঁধ তৈরির কাজ।
জড়িয়ে দিচ্ছে আ. লীগের শীর্ষ নেতাদের নাম!: প্যারাবন নিধন করে ঘের তৈরির জন্য প্রভাব বিস্তার করতে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম বলছে ভূমিদস্যুরা। তারা প্রকাশ্যে লোকজনের কাছে বলা বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক এড. সিরাজুল মোস্তফা ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান তাদের শেল্টার দিচ্ছেন। এছাড়াও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও তাদের সাথে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের শেল্টারের বিষয়টি বলে লোকজনের কাছে প্রভাব তৈরি করছেন। ফলে পরিবেশ বিধ্বংসী এমন ন্যাক্কারজনক কর্মকান্ডেও স্থানীয় সচেতন মহলসহ সাধারণ লোকজন ভয়ে মুখ খুলছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক এড. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘এটা এমনটি প্রশ্নই আসে না। জীবনে অনেক সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু কখনো অনৈতিকতার আশ্রয় নিইনি। ভূমিদস্যুরা হয়তো নিজেরা বাঁচার জন্য আমার নাম বিক্রি করছে। নয়তো আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্র করে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি হাস্যকর ও বিভ্রান্তিমূলক। অপরাধীরা অপরাধ সংগঠনের জন্য নেতাদের নাম বিক্রি করে। এটাও এমন একটি অপচেষ্টা।’
আ.লীগ-বিএনপি একাট্টা: বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ-বিএনপির লড়াই চললেও সরকারি জমি দখলতে একট্টা হয়েছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতারা। দুই দলের নেতারা একজোট হয়ে প্যারাবন কেটে ভূমি দখল করে পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগাচর ঘোনার পেছনের ভূমি দখলকারীদের চক্রের নেতৃত্বদানকারী এরশাদ কুতুবদিয়া সাবেক চেয়ারম্যান নূরুল ইসলামের পুত্র। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্য কালাকাজির পাড়ার আবদুল মতিন। তিনি ছাত্রজীবনে ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। চক্রের আরেক সদস্য নেজাম উদ্দীন নাজুও বিএনপির ঘরানার লোক। আরেক সদস্য শাহাদাত হোসেন ওয়ার্ড বিএনপির নেতা। মামলায় নাম না উঠলেও ইউনিয়ন বিএনপির একাংশের এক শীর্ষ নেতা এই চক্রের অর্থদাতা বলে মামলার তদন্তে তথ্য পেয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে অমাবশ্যাখালীর মৌজার সরকারি ভূমি দখল চক্রের নেতৃত্বদানকারী শাহাব উদ্দীন রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও আওয়ামী ঘরানার লোক। তিনি দীর্ঘদিন এলাকায় থাকেন না। তবে সম্প্রতি একটি ব্যাংকের এজেন্ট নিয়ে এলাকায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। তার জন্য গড়ে তুলেছেন লবণ চাষী কল্যাণের একটি কথিত সংগঠন। শাহাব উদ্দীনের এই ভূমি দখল চক্রের অন্যতম সদস্য মারুফ নামের বড়মহেশখালীর এক ব্যক্তি। রয়েছে আরো কয়েকজন। এভাবে বিএনপি-আওয়ামী লীগ একট্টা হয়ে প্যারাবন কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছেন। সরকার পরিবর্তন হলেও দখল ধরে রাখতেই এভাবে বিএনপি-আওয়ামী লীগ একট্টা হয়েছে- এমনটি বলে বেড়াচ্ছেন ভূমিদস্যুরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত এরশাদুল ইসলাম বলেন, ‘জমিগুলো ১৯৩৭ সালে আমার পূর্বপূরুষদের খতিয়ান নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে সাগরের গ্রাসের বিলীন হয়ে যাওয়ায় দখলে ছিলো না। সম্প্রতি চর জেগে উঠায় জমিগুলো আমরা দখলে যাচ্ছি। তবে এতে আমাদের বাধা দিচ্ছে বনবিভাগ। তারা অন্যায়ভাবে আমাদের নামে মামলা করেছে। আমরাও পাল্টা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ তবে মুঠোফোন বন্ধ থাকায় আরেক প্রধান অভিযুক্ত শাহাব উদ্দীনের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
রহস্যজনক ভূমিকায় কর্তৃপক্ষ: বনবিভাগের চোখের সামনেই সরকারিভাবে সৃজিত প্যারাবনের প্রায় অর্ধলাখ গাছ কেটে ফেলেছে ভূমিদস্যুরা। কিন্তু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিষয়টি সর্বমহলে জানাজানি হয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে কিছুটা নড়েচড়ে বসে বনবিভাগ। এর মধ্যে নামমাত্র অভিযান চালিয়ে কিছু বাঁধ কেটেছে। দুই তিন মামলা হওয়ার কথা জানা গেলেও তা নিয়ে লুকোচুরি খেলছে। এমনকি মামলার এজাহারে নাম আসা কয়েকজনের নাম বাদ দিতেও চেষ্টা করা হচ্ছে বলে কথা উঠছে। একারণে বনবিভাগের ভূমিকাকে রহস্যজনক দাবি করছেন সাধারণ লোকজন।
তারা বলছেন, সুবিধা নিয়ে বা নিতে নীরব ভূমিকা পালন করছে বনবিভাগের লোকজন। তবে এর মধ্যে মহেশখালী থানা পুলিশের একটি দল প্যারাবন কেটে ঘের তৈরির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রণব চ্যৌধুরীর নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে কিছু সরঞ্জামাদি গুড়িয়ে দিয়েছে জানিয়েছে পুলিশ। বিশাল প্যারাবন নিধন করে ঘের তৈরি করায় মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ। অন্যদিকে প্যারাবন কেটে ফেলায় জলোচ্ছ্বাসে লোকালয় ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কা করা হচ্ছে। অধিগ্রহণ করা জমি রক্ষাকবচখ্যাত প্যারাবন কেটে ফেলায় সরকারের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই নিয়ে সচেতন লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
সাধারণ লোকজন বলছেন, চোখের সামনে এভাবে পরিবেশ ধ্বংস হতে দেয় যায় না। এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। জড়িত সব ভূমিদস্যুদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা’র জেলা সভাপতি সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, মহেশখালীতে ভূমিদস্যুরা দুর্ধর্ষভাবে প্যারাবন কেটে খাস জমি দখল করছে। এতে কয়লাবিদ্যুৎসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের চাপে ঝুঁকির মুখে থাকা মহেশখালী পরিবেশগতভাবে মারাত্মকভাবে সংকটে পড়বে। আমরা চাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত কঠোর হয়ে প্যারাবন নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘মহেশখালীতে প্যারাবন কাটার বিষয়টি তাদের নজরে আসেনি। খোঁজ-খবর নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এই প্রসঙ্গে জানার জন্য উপকূলীয় বনবিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জের রেঞ্জার আনিসুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি। তাই তার বক্তব্য জানা যায়নি।
জানতে চাইলে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইয়াছিন জানান, এটি তার দেখার বিষয় নয়। কি করবে না করবে সেটি বনভিাগ বুঝবে।
এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্যারাবন কাটার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিয়মিত পৃথক দুটি দল টহলে রয়েছে এবং একাধিক মামলাও করা হয়েছে। ’