-জিয়াবুল আলম

গত কয়েকদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের এক বিজ্ঞ আইনজীবী আপীল বিভাগে আপীল শুনানীর সময় অভিযোগ করেন, আপীল বিভাগে আপীল নিষ্পত্তির আগে যশোরের কেন্দ্রীয় কারাগারে ঝড় ও মুকিম নামে দুই আসামীর মৃত্যু দন্ড কার্যকর করা হয়। ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে আসামী পক্ষের আইনজীবী আপীল বিভাগে অভিযোগ করেন , আসামীদ্বয়ের বিরুদ্বে ২০০৮ সালে বিজ্ঞ নিম্ন আদালতের হত্যার অভিযোগে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৮ ধারা মোতাবেক ফাসির রায় দেন। পরবর্তী হাইকোর্টের আপীল শুনানী শেষে ২০১৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগ নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন। এরপর হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হলে উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা যথাসময়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৩ মোতাবেক সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে আপীল বিভাগে আপিল করেছেন বলে দাবি করেছে তাদের আইনজীবীরা।কিন্ত আপীল চলমান থাকা অবস্হায় আসামীদ্বয়ের মৃত্যু দন্ড কার্যকর করেন

তবে রাষ্ট পক্ষের বক্তব্য হচ্ছে যে,হাইকোর্টের রায়ের পর আসামিরা জেল আপিল করেছিল। ২০১৬ সালের আপিল বিভাগে তার শুনানি হয়। সেখানে জেল আপিল খারিজ হলে দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনও করেছিল। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর প্রাণভিক্ষার আবেদন নামঞ্জুর হয়। এর পরে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল মনে করছেন, এ অবস্থায় ওই দুই আসামির করা নিয়মিত আপিল অকার্যকর হয়ে যাবে।

এই কথা অসত্য নয়,কারণ আপীল চলাকালীন এ্যাপিল্যান্ডের মৃত্যু হলে এই ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩১ ধারা মোতাবেক আপীল পন্ড হয় ঠিক আছে।তবে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য প্রদান করায় কোনটা সত্য কিংবা কোনটা মিথ্যা আপীল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।তবে এখানে বেশ কিছু প্রশ্ন উৎপত্তি হয়েছে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে জেলার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার সময় জেল কোড অনুসরণ করছে কি? ফাসি কার্যকর করার আগে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল দাখিল করেছে কিনা? সুপ্রিম কোর্টে আপীল বিভাগে আপীল দাখিলের পর রায় কার্যকর করার আগে জেলারকে অবহিত করেছিল কিনা?
এখানে ১ম প্রশ্ন অনুযায়ী একজন ফাঁসির আসামির মৃত্যু দন্ড কার্যকর করার পূর্বে জেলা কোড সহ দেশের প্রচলিত আইনের নিদিষ্ট কিছু বিধান অনুসরণ করতে হয়। যেমন. ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৭১ ও ৩৭৪ ধারার বিধান মতে কোন আসামীর বিরুদ্ধে বিজ্ঞ এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত কতৃক যদি মৃত্যু দন্ড প্রদান করে তাহলে উক্ত আসামী বর্ণিত ধারা মোতাবেক মহামান্য হাইকোর্টের এখতিয়ার সম্পন্ন বেঞ্চে সাত দিনের মধ্যে আপীল করবে।পাশাপাশি মৃত্যুদন্ড প্রধানকারী আদালত ক্রিমিনাল রুল এন্ড অর্ডার অনুসারে উচ্চ আদালতের নথি তলবের রিকুইজিশন স্লিপ পাওয়ার পর নিম্ন আদালতের নথিসহ যাবতীয় কাগজ পত্রাদি তিন কার্যদিবসের মধ্যে মহামান্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে প্রেরণ করবেন। আসামি যদি আপীল করে উনার আইনজীবী সমস্ত বক্তব্য উপস্হাপনের পর বিজ্ঞ আদালত যদি সাজা বহাল রাখে, এই ক্ষেত্রে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৩ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের আপীলের সুযোগ আছে।মৃত্যু দন্ডের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে আপীল দাখিলের পর আপাতত অধস্তন আদালতের সাজা উচ্চ আদালতের আপীল চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আর বহাল থাকে না।ধরে নিলাম আপীল আদালতে সাজা বহাল রাখা হয়েছে, এই ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে রিভিউ করার সুযোগ আছে। যদি রিভিউতে সাজা বহাল রাখে,তখন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ ও জেল কোডের (কারাবিধি) ৯৯১ বিধিমতে মোতাবেক দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপথির নিকট প্রাণ ভিক্ষার সুযোগ আছে।
যদি উপরোক্ত বিধি মোতাবেক রাষ্ট্রপথি ক্ষমা মার্জনা না করে, সেই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের আদেশ প্রাপ্তির ২১ দিন থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করবে কারা কতৃপক্ষ। সাধারণ ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর ফাঁসি কার্যকরের এটাই নিয়ম।তবে জেল কোর্ডের বিধান অনুযায়ী মৃত্যু দন্ড কার্যকরের সময় বিধি ৯৯৯ অনুযায়ী দন্ডিত ব্যাক্তির আত্মীয় স্বজনের সাথে শেষ দেখার সুযোগ আছে।

এখানে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক করে, সেটি হচ্ছে আসামীর মৃত্যু দন্ড কার্যকরের দিন উক্ত বিধি অনুসারে স্বজনদের সাথে দেখা করার সুযোগ দিয়েছিল কিনা? যদি দেখা করার সুযোগ দিয়ে থাকে, তাহলে উক্ত আসামীদ্বয় সাজার বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে আপীল করেছে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সাথে কথা বলে কেন কারা কতৃপক্ষকে অবহিত করলনা? অথবা কারা কতৃপক্ষ পক্ষকে অবহিত করার পরে-ও যদি ফাঁসি কার্যকর করে, এই ক্ষেত্রে কারা কতৃপক্ষ সংবিধানসহ দেশের প্রচলিত আইনকে চরমভাবে অবমাননা করেছে। কারণ সংবিধানের ২৭/৩১/৩৫অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে আইনি আশ্রয় লাভ এবং অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে স্বাধীন নিরপেক্ষ আদালত কিংবা ট্রাইব্যুনালে বিচারেন অধিকার রয়েছে। পাশাপাশি সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুসারে ব্যাক্তির জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা আছে। যদি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ আইনের বিধিনিষেধ অনুসরণ না করে কোন আসামীর বিরুদ্ধে মৃত্যু দন্ড কার্যকর করে, সেক্ষেত্রে সংবিধানের তৃতীয় বিভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকার খর্বের সামিল। সংক্ষুব্ধ আসার পরিবার চাইলে সংবিধানের ৩১।২৭।৩২।৩৫।৪৪।১০২ অনুসারে রিট করে মহামান্য হাইকোর্টে বিভাগের নিকট প্রতিকার চাইতে পারে। যেহেতু আসামীদ্বয়ের আপীল চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য পুনরায় তারিখ মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কতৃক ধায্য করেছে, তাই আপীল নিস্পত্তির সময় জানা যাবে এখানে আসল ঘটনা কি ছিল?কারণ রাষ্ট্র পক্ষ এবং আসামি পক্ষ পরস্পর বিরোধী বক্তব্য উপস্হাপন করেছে।

লেখক: আইনজীবী, চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত