আবদুল নবী

জীবনের শুরুটা খুবই নিকুত ও সুন্দর হয়। যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন সবাই কত আদর যত্ন করে তার কোন শেষ নেই। আদর যত্ন করে সকল চাহিদা মিটিয়ে বড় করতে থাকে। তবে এই আদর-যত্নের পিছনে সবার একটা এসপেক্টেশন থাকে। ছেলে সৎ ও আদর্শের সাথে বড় হয়ে পরিবারের সবার স্বপ্ন পূরণ করবে। বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে ছেলের কাছে ভালো থাকবে এটাও বাবা-মায়ের একটা আশা । বয়স যতোই বাড়ে সবকিছু কেমন জানি পানসে হয়ে যায়। আগের মতো আর ভালো লাগে না। ২২ থেকে ৩০ বছর বয়সে বোঝা যায় সেই আদর, ভালোবাসার কাছে কতটা অসহায় হয়ে জীবন পার করতে হয় সেটা।

‘‘এই যে শুনছেন, আপনার ছেলে এখন হাঁটতে পারে।”- এই কথাটা যতদিন বলে নাই ততোদিন ছেলেকে কোলে কোলে রাখে, বুকে জড়িয়ে রাখে। যেদিন থেকে হাঁটা শুরু সেদিন থেকে ভালোবাসা কমতে থাকে। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলো। তারপর শুরু তার জীবনের আরেকটা অধ্যায়। পরিবারের সবার ভালোবাসার সেই ছেলেটার কাঁধে এখন বই ভর্তি ব্যাগ। সকালে কোন রকম নাস্তা করে স্কুলে; স্কুল থেকে আসতে না আসতে টিউশন টিচার্স এসে হাজির। অর্থাৎ ছেলেটার যখন একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার তখন তাকে ব্যস্ত রাখা হয় বইয়ের মধ্যে।

অবশেষে স্যার চলে গেলো। যেতে যেতে বিকাল ৪ টা কিংবা ৫টা। এবার সে একটু খেলবে এমন প্রস্তুতি নিবে এমন সময় মা বলে উঠলো ‘‘বাইরে যায় না, বাবা। বাজে ছেলেদের সাথে মিশা ভালো না”। তার মানে খেলা বন্ধ। টিভির রিমোট কিংবা স্মার্টফোন হাতে ধরিয়ে দিলো। ব্যাস! ছেলে এখন আর বাইরে যাওয়ার চিন্তাও করে না। সবমিলিয়ে ঘুম থেকে উঠে স্কুল, সেখান থেকে বাড়ি। তারপর পড়া, মোবাইল এভাবেই তার জীবনটা একটা বাউন্ডারির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেলো। খুব ভালোভাবে পড়ে মুখস্থ করে এবার ছেলে পরীক্ষা দিলো। ভালো রেজাল্ট করলো। ছেলেকে অনেক আদর ও গিফট দিলো। সেই সাথে তার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো এবার আরও ভালো করতে হবে। এভাবে তার জীবনটা একটা গর্তে পড়ে যায়। প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম হতে না পারলে ছেলেকে মানসিক চাপ দেওয়া হয়।

লোভ দেখানো হয় ক্লাসে ফার্স্ট হলে তোমাকে এটা কিনে দিবো; ওখানে ঘুরতে নিয়ে যাবো। ছেলেও সেই আশায় মুখস্থ বিদ্যায় লেগে পড়ে। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি-তে এ+ না পেলে তাকে নানাভাবে চাপ সহ্য করতে হয়। নিজের বাবা-মাও এমন অনেক কথা বলা হয় যার ফলে সেই ছেলে নিজেকে একটা ভারসাম্য অবস্থায় রাখতে না পেরে বিষণ্নতায় ভোগতে থাকে। এমন সময় তাকে সঙ্গ দেওয়া উচিত। কিন্তু সেটা না করে তাকে আরও কটু কথা বলতে থাকে। অমুকের ছেলে কত ভালো রেজাল্ট করেছে আর আমার ছেলে কি করলো; কি করলাম খাওয়ায়! আমাদের মানসম্মান কি আর থাকলো! আরও কত কথা তার শেষ নেই। তাছাড়া যে বা যারা এই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে শুধু তারাই এই বিষয়টা ভালো বুঝবে।

ধরেই নিলাম এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত যে ছেলে জিপিএ-5 ছাড়া কোন রেজাল্ট করলো না সে কোন না কোন কারণে পূর্বের তুলনায় খারাপ রেজাল্ট করলো। তার জন্য বাবা-মা সমাজে মুখ দেখাতে পারছে না। আত্মীয়স্বজনের কাছে নিজেদের সম্মান নষ্ট হয়ে গেছ তাই ছেলেকে বকা, গালাগালি কিংবা প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনের মধ্যে যেতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকে একমাস , দু’মাস। হুট করে পরদিন সকালে ছেলে আর রুম থেকে আর বের হচ্ছে না। বাবা-মায়েরও কোন চিন্তা নাই। জমিদারের ছেলে একদিকে খারাপ রেজাল্ট করছে আর এদিকে দিনের বারোটা্ পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে। যে যার মতো আছে।

কাজের একটা ফাঁকে মা ছেলের রুমের দিকে গিয়ে এক বৃহৎ আত্মচিৎকারে বাড়ির সবাই এসে হাজির। এসে দেখে কিছুক্ষণ আগেও যে ছেলেকে বকা দিলো সেই ছেলের লাশ লটকে আছে ফ্যানের সাথে। বিছানার এককোণে একটা চিঠি। চিঠিতে লিখা ছিলো—-

মা জানো,

আমি সবসময় চেষ্টা করতার ক্লাসে ফার্স্ট হতে এবং ফার্স্টও হয়েছি। কিন্তু গত একটা পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হতে পারিনি। তাই তোমাদের মানসম্মান নষ্ট হলো। আমার জন্য তোমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারতেছো না। অফিসে তোমাদের কলিগের মেয়েও তোমাদের ছেলের চেয়ে ভালো। বাইরে বের হওয়ার মতোও তোমাদের মুখ নাই।

জনো মা, আজ থেকে আমার জন্য তোমাদের আর কখনো মানসম্মান নষ্ট হবে না। অফিসের কলিগের মেয়ের সাথে তোমার এই অকর্মা ছেলের তুলনা করতে হবে না। যে সমাজে সম্মানের ভয় ছিলো এখন থেকে সেই সমাজে সম্মানের সাথে থাকতে পারবে। সবার সাথে হাসিখুশি থাকতে পারবে। তবে সেই সমাজে আমি থাকলাম না। যে সমাজ আমাকে কিছু একটা করার সুযোগ দিলো না সেই সমাজ আমার জন্য না। তাই তোমাদের থেকে অনেকদূর চলে এলাম।

জানি তোমাদের কাছে আমি ঋণী। কারণ তোমরা আমাকে জন্ম দিয়েছ এবং কত আদর যত্ন করে বড় করেছ। বিনিময়ে তোমাদেরকে আমি কিছু দিতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।

আর হ্যাঁ, বাবাকে বলিও প্রতিদিন আর টাকা চাইবো না। প্রতিদিন আমার জন্য যে ১০০টাকা করে টেবিলে রাখতো তা আর রাখতে হবে না।

ক্ষমা করে দিও

এবার বাবা-মায়ের কান্নায় এলাকাবাসীও চলে এলো। সবাই কান্না করছে। দাফন দেওয়া হলো। মিডিয়ায় বড় বড় অক্ষরে শিরোনাম দেওয়া হলো, ‘‘পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে না পারায় এক ছাত্রের আত্মহত্যা”।

কি পেলো এই সমাজ এভাবে একেকটা তরতাজা ফুটন্ত ফুল ছিড়ে ফেলে? একজন শিক্ষার্থী সবসময় ভালো রেজাল্ট করবে এমন তো হয় না। প্রত্যেকের জীবনে সফলতা ছাড়া ব্যর্থতা থাকবে না এমনতো হতে পারে না।

আপনার ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করছে। সমাজের মানুষ সমালোচনা করছে তাই বলে ছেলেকে যা মন চাই কথা বলবেন না। সমাজের মানুষের কাজ হচ্ছে সমালোচনা করা। আপনার ছেলে এই বছর খারাপ করছে তাতে কি আপনি তাকে ভালো করে বোঝান, তাকে উৎসাহ দেন। তাকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়তে দিবেন না। সে ভেঙ্গে গেলে আপনার ক্ষতি। কারণ সে আপনার ছেলে। পৃথিবীর সকল মানুষ আপনাকে কি বলবে তা না দেখে আপনার ছেলেকে সফল হতে সাহায্য করুন। সমাজের নষ্ট মানুষের কথায় ছেলের ফুটন্ত জীবনকে ছিড়ে ফেলবেন না।

বর্তমান সময়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাথে হচ্ছে। খুব কম শিক্ষার্থী আছে যারা এই সমস্যার মুখোমুখি হয় নাই। খবরের কাগজ খুললেই এরকম একটা না একটা খবর চোখে পড়ে। সমাজ কি বলবে সেটা দেখার সময় না। ছেলে আপনার। আপনার ছেলের কাজ নিয়ে সমালোচনা হবে এটা স্বাভাবিক। আর মানুষ হলে তো অবশ্যই সমালোচনা হতে হবে। এটাই জীবন।

একইভাবে সকল শিক্ষার্থীদেরও মনে রাখা উচিত যে সমাজের মানুষ কি বললো কি বললো না তা নিয়ে ভাবনার সময় নাই। জীবনটা তোমার। তুমি একবার ব্যর্থ হয়েছো, দুই বার ব্যর্থ হয়েছো। তাই বলে ভেঙ্গে পড়ার কোন কারণ নাই। নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলে সফল হয়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়ে প্রমাণ করে দাও তোমার দ্বারা সবই সম্ভব।

নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। দেখবেন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এমনিতেই বদলে যাবে। তখন আর কাউকে এভাবে বিছানার এককোণায় চিঠি রেখে সকল কষ্ট কলমের কালি দিয়ে লিখে আত্মহত্যা করতে হবে না।


আবদুল নবী ,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ,কক্সবাজার সিটি কলেজ, কক্সবাজার।