মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আসামীদের দায়ের করা আপীল মামলাটি সম্ভব হলে চাঞ্চল্যকর মামলা হিসাবে আইনানুগভাবে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস।
সিনহা হত্যাকান্ডের ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিচারের রায় কার্যকর করার দাবিতে সোমবার (৩১ জুলাই) বিকেলে কক্সবাজার শহরের শহীদ সুভাষ হল (পাবলিক লাইব্রেরী হল) এ অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ অনুরোধ জানান।
সিনহা হত্যা মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে তাঁর এক বোন ব্যতীত পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। সারাজীবনই প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরিবারের সদস্যদের হারনোর বেদনায় আপ্লূত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্যদের হারানোর মর্মবেদনা তাঁর চেয়ে অনেক বেশি উপলব্ধি করেন।
তাঁর ভাই মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার পর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত ফোনে তাঁর মা’র সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে সান্তনা দিয়েছিলেন। একমাত্র সন্তান সিনহা-কে হারিয়ে সিনহা’র মা এখন অসুস্থ। নাহয়, এ অনুষ্ঠানে সিনহার মা আসতেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাইকোর্টের আপীল মামলাটি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তাঁর অসুস্থ মা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, মেজর (অব:) সিনহা খুবই দেশপ্রেমিক ছিলেন। সিনহা’র কাছে জন্মদাতা মা যেমন, একইভাবে তাঁর কাছে প্রিয় মাতৃভূমিটাও তেমন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সিনহা কমিশন লাভের পর তাঁর মাকে বলেছিলেন, “মা আমি শুধু তোমার সন্তান নই, দেশমাতৃকারও সন্তান। সুতরাং এদেশের জন্য আমার প্রাণ গেলেও তুমি কোন আপসোস করবেনা”।
শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস তাঁর ভাই সিনহাকে একজন মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন, নীতিবান, আদর্শিক, নির্লোভ, স্বজ্জন, অমায়িক, ও পরোপকারী ছিলেন বলে উল্লেখ করে বলেন, ভাইকে তো আর জীবিত ফেরত পাবোনা, তবে অপেক্ষাকৃত দ্রুততম সময়ে বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে, তা দেখতে পেলে তিনি সহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা শান্তি পাবেন।
তাঁর ভাই সিনহা হত্যা মামলা তাঁর পরিবারের জন্য একটা দুঃস্বপ্নের মতো। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে অনেকটা মহাকাব্য রচিত হবে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস কান্না ও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক, দৈনিক আমাদের কক্সবাজার, দৈনিক আমাদের বাংলা পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মিজানুর রহমান’র সঞ্চালনায় সিনহা হত্যা মামলার মূখ্য আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ, অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট মোজাফফর আহমদ হেলালী, নির্যাতিত সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার আর্ট ক্লাবের চেয়ারম্যান তানভীর সরওয়ার রানা, অ্যাডভোকেট সেলিম উল্লাহ, অ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম টিপু, নির্যাতিত পরিবারের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন মেম্বার প্রমুখ।
নিহত মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান’র পরিবার ও কক্সবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের উদ্যোগে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের আগে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া, প্রায় একহাজার এতিম, দুঃস্থ, অসহায়, গরীব ও ছিন্নমূল মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানমালায় কক্সবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের সদস্যরা ছাড়াও সর্বস্থরের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভায় নাজনীন সরওয়ার কাবেরী বলেন, মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান শুধু একজন ব্যক্তির নাম নয়, একটি প্রতিবাদের প্রতীক, আমাদের প্রেরণা, আমাদের আলোকবর্তিকা। সিনহা হত্যার কারণে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড অনেকটা বন্ধ হয়েছে। কক্সবাজারে আসা পর্যটকেরা নিরাপত্তা পাচ্ছে।
আলোচনা সভায় কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ বলেন, সিনহা হত্যা মামলার বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করতে আদালতকে সর্বোচ্চ সহায়তার চেষ্টা করেছি। পেশাদারিত্ব, দায়িত্ববোধ ও নিষ্ঠার সাথে মামলাটি পরিচালনা করেছি।
সভায় বক্তারা কোভিড-১৯ সহ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দ্রততম সময়ের মধ্যে সিনহা হত্যা মামলার সাহসী রায় দেওয়ায় কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। বক্তারা বলেন, এ রায়ে সারাদেশে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়েছে। বিচারপ্রার্থীদের মাঝে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা আরো বেড়েছে। এরায়ে প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে “বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড”। এ রায়কে বক্তারা একটি ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী ও দৃষ্টান্তমূলক রায় বলে অভিহিত করেছেন। বক্তাদের মতে, করোনা পরিস্থিতিতেও অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি বিজ্ঞ বিচারক নিষ্পত্তি করতে পেরেছেন। যা বিজ্ঞ বিচারকের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতার অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলী’র গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
হত্যাকান্ডের ৫ দিনের মাথায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহা’র বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), পরে বিচারিক আদেশে মৃত্যুদন্ডাদেশ হওয়া প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর : এসটি-৪৯৩/২০২১ ইংরেজী। যার জিআর মামলা নম্বর : ৭০৩/২০২০ ইংরেজি। যার টেকনাফ মডেল থানা মামলা নম্বর : ৯/২০২০ ইংরেজি।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী-কে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত’কে। আদালত থেকে র্যাব-১৫ কে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়।
এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষী সহ আলোচিত মামলাটির চার্জসীট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন র্যাব-১৫ এর তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে মেজর (অব:) সিনহা হত্যাকান্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ৩০০ পৃষ্ঠার এ মামলার ঐতিহাসিক রায় দেন। মামলায় ২ আসামীকে মৃত্যুদন্ড ও ৬ আসামীকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করা হয়। মৃত্যুদন্ড দেওয়া আসামীরা হলো-বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
এছাড়া একই রায়ে ৬ আসামী যথাক্রমে কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন, আয়াজ উদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়। রায়ে সাজাপ্রাপ্ত ৮ জন আসামীর প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ডও প্রদান করা হয়।
মামলার বাকী ৭ জন আসামীকে মামলার দায় থেকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়। তারা হলো-কনস্টেবল সাফানুর করিম, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব, কামাল হোসেন আজাদ ও মো. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা পরে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করে। হাইকোর্টে দায়েরকৃত আপীল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট জানা গেছে।