বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
নির্বাচনের বাকি আর দুই মাস; রাজনীতির মাঠে শুরু হয়ে গেছে সংঘাতের দামামা। বৈশ্বিক সংকটে চাপে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে ফিরে এসেছে রাজনৈতিক অস্থিরতার পুরনো সেই বিপদের শঙ্কা।

ভোটের রাজনীতি যদি রাজপথের সংঘাতে গড়ায়, তাতে বাধাগ্রস্ত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন পড়বে ক্ষতির মুখে। আর সেটা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে আরও চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।

একই দিনে দুই দলের সমাবেশ ঘিরে গত কয়েক মাস জনমনে যে উদ্বেগ ছড়িয়েছিল তা শঙ্কায় পরিণত হয় শনিবার দুপুরের সংঘর্ষের পর।

এতে প্রায় ৪৫ মাস পর দেশে ফিরেছে হরতাল, সঙ্গে এসেছে হত্যা, আগুন, ভাঙচুর, সহিংসতা। আট বছর মসৃণভাবে চলার পর ব্যবসা বাণিজ্যের পথে কাঁটা হতে ফিরে এসেছে তিন দিনের অবরোধ।

নির্বাচন সামনে রেখে সংঘাত আর জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির যে শঙ্কা ছিল, সেটাই এখন ভাবাচ্ছে ব্যবসায়ী, বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের।

বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আলোচনা আর ইউক্রেইন যুদ্ধ চলার মধ্যে ফিলিস্তিনে নতুন করে সংঘাতে জ্বালানির দাম নিয়ে শঙ্কার মধ্যেই দেশের অর্থনীতিতে নতুন দুশ্চিন্তা দেখছেন তারা।

করোনাভাইরাস মহামারীর ধাক্কা সামলে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল। কিন্তু এরপর অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পর্যায়ে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। একে দিকে ডলার সংকটে জেরবার হতে হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে পিষ্ট হতে হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে।

নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে, হরতালের এক রাতে আলু-পেঁয়াজের দর বেড়েছে আরও। সব মিলিয়ে সময়টা আবার কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলেই সবার ভাষ্য।

এমন অবস্থায় সমঝোতা ও সহিষ্ণুতার চর্চা শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন যা শুরু হয়েছে তাতে আমাদের অর্থনীতির ওপর বড় একটা আঘাত আসবে। কল-কারখানা ঠিকমত না চললে আমদানি-রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়বে, সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ব।”

তার ভাষায়, দেশের কল্যাণের জন্যই সবাই রাজনীতি করে। তাই যদি হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কর্মকাণ্ড এড়িয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়ার কথা চিন্তা করা উচিত।

দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটের এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত এবং ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা কয়েক মাস বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতা দেখেছে বাংলাদেশ, ঝরেছে বহু মানুষের প্রাণ। বরাবরের মতোই সাধারণ মানুষকে মূল্য দিতে হয়েছে বেশি।

পরের নির্বাচনহয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। তার আগে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষ ভোটে আসায় পরিস্থিতি শান্ত ছিল।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়কের পুরনো দাবিতে ফিরে গেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। তবে এক বছরের বেশি সময় ধরে তাদের ধারাবাহিক যেসব কর্মসূচি চলছিল, মোটাদাগে তা শন্তিপূর্ণই ছিল।

কিন্তু শনিবার রাজনীতির মাঠে ফিরে এসেছে সংঘাত-সহিংসতার চেনা দৃশ্য, যার শঙ্কা বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল।

অতীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশকে কম ভোগায়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ফেলেছে বিরূপ প্রভাব। তাই নতুন করে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, আশঙ্কা চারদিকে।

রাজনৈতিক এ অবস্থাকে ‘মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ’ বলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার কথা চিন্তা করতে হবে। এছাড়া সাধারণ মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না, কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

“ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমাদের আহ্বান থাকবে, এমন কোনো কর্মসূচি যেন না আসে যাতে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যথায় আমরা পিছিয়ে যাব।”

খেলাপি ঋণের চাপে থাকা ব্যাংকিং খাতের উপর রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব ব্যাপক হবে বলে আশঙ্কা ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) এর সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারীর পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় সফলতা দেখিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ঘুরে দাঁড়ানোর সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে গত বছরের জুলাই থেকে সবকিছু উল্টে পাল্টে গেছে।

“বিনিময় হারের প্রতিযোগিতায় টাকার মান কমে আসছে। বাড়তি মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে সুদহার বাড়াতে হয়েছে। এতে ব্যাংকিং খাত চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। এখন হারতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কেনাকাটা কমে যাবে মানুষের। এতে নগদ টাকার প্রবাহ কমে যাবে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। তারল্য সংকটের এই সময়ে খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরো ভঙ্গুর হবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, কোনো ধরনের সংঘাত ছাড়া একটি সুন্দর নির্বাচন দরকার। ক্ষমতায় যে সরকারই আসুক, একটি স্থিতিশীল সরকার দরকার। সব রাজনৈতিক দলের কাছে সেই প্রত্যাশা।”

দেশের রপ্তানির মেরুদণ্ড তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের কপালেও এখন চিন্তার ভাঁজ।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতা হলে, হরতাল সহিংসতা হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের ক্ষতি তো হবে সবার আগে। আমাদের পণ্য পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি বলেন আর হরতাল আবরোধ বলেন- এগুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্য।”

গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় পোশাক খাতে টানা প্রবৃদ্ধির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এতে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে। আমরা উভয় রাজনৈতিক দলকে বলব- এই সমস্ত জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি পরিহার করুন। তাহলে ব্যবসায়ীদের জন্য এবং সামগ্রিকভাবে দেশের জনগণের জন্য ভালো হবে।

ওষুধ, তৈরি পোশাক এবং প্লাস্টিক সামগ্রী প্যাকেট করার কাজেই মূলত ব্যবহার হয় কাগজের কার্টন বক্স। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে তৈরি হওয়া বেশির ভাগ কার্টন বক্স ব্যবহার হয় প্লাস্টিক সামগ্রী প্যাকেট করার কাজে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি |
“এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এই দেশে আসতে চাইবে না।”

তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম এখনও ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছেন।

হরতাল অবরোধের মত কর্মসূচি রপ্তানিমুখী শিল্পে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় এখন মন্তব্য করাটা তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে। আমরা আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে এ নিয়ে কথা বলব।”

রিজার্ভের পতন ঠেকানোর উপায় কী?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়দি সাত্তার বলেন, “রপ্তানি এবং রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুটি পিলার। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে আমাদের রপ্তানির ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এছাড়াও রেমিটেন্সের ওপরেও কিছুটা প্রভাব তো অবশ্যই পড়বে।

“উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদদের দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে এমন কর্মসূচি নিতে হবে, যাতে রপ্তানি, আমদানি, বিনিয়োগ এবং রেমিটেন্স কোনো খাতেই যেন ক্ষতি না হয়।”

জাইদি সাত্তার বলেন, আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি ‘বড় লাফ’ দেওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজ লাগাতে এখন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

“ওই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের রাজনীতিবিদদেরকে অবশ্যই দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অস্থিতিশীল পরিবেশ থাকলে সেখানে বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগকারীর স্থিতিশীল দেশেই বিনিয়োগ করেন।”