রেজাউল করিম চৌধুরীঃ
গত কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে অসমতার বিরুদ্ধে করা ক্যাম্পেইন বা প্রচারণাসমূহকে আমাদের ফেসবুক বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা বেশ প্রশংসা করছেন। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আপনারা জানেন, সম্প্রতি সুইজারলেন্ড এর দাভোস-এ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের [Economic Forum-WEF] ৫৪তম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এবং বিশ্বব্যাপী অসমতার বিরুদ্ধে সংরগ্রামরত নাগরিক সমাজের সংগঠণ “Fight Against Inequality Alliance” এর বৈশ্বিক আহবানে সাড়া দিয়ে এবং সংহতি জানিয়ে আমরা বাংলাদেশেও এই ক্যাম্পেইনগুলো সংগঠিত করছি।

অধিকার ভিত্তিক নাগরিক সংগঠণসমুহের সমালোচনা রয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে এবং দেশের মধ্যে যে অসমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার সুযোগ সৃষ্টির পেছনে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথা WEF এর ভুমিকা রয়েছে।

কারণ, তথাকথিক অর্থনৈতিক সহযোগীতা ও নিরাপত্তার নামে WEF বিশ্বব্যাপী বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর মুনাফা তৈরী, অর্থ ও সম্পদ পাচারের সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করছে। এ ছাড়াও ধনী দেশগুলোকে সহায়তার উদ্দেশ্যে বাজার ব্যবস্থার উপর বিশ্বাসী আন্তর্জাতিক এনজিওসমুহও [INGOs ] এই সম্মলনে অংশগ্রহন করছে। তবে WEF এর এই ধারনাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য বিকল্প হিসাবে বৈশ্বিক নাগরিক সমাজের সংগঠণ “ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ফোরাম” [World Social Forum-WSF] তৈরী হয়েছে এবং কাজ করছে।

বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে এবং দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসমতার বিষয়টির উপর সম্প্রতি অক্সফাম একটি গবেষনা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জনাব অমিতাব বিহার [অক্সফাম-ইন্ডিয়ায় কাজ করেন] বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এই সম্মেলনে অংশগ্রহন করেছেন এবং তিনি সেখানে বিশ্বব্যাপী অসমতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন এবং ন্যায্যতাভিত্তিক পুন:বন্টনের [Re-distributive justice] ধারনাটি নিয়ে সেচ্চার হয়েছেন। Re-distributive Justice বা ন্যায্যতাভিত্তিক পুন:বন্টন হচ্ছে কল্যানকামী রাষ্ট্রসমুহ তাদের দেশে ধনীদের থেকে কর আদায় নিশ্চিত করবে, দরিদ্র দেশগুলো থেকে ধনী দেশসমুহে মুনাফার নামে অর্থ পাচার বন্ধ করবে এবং আদায়কৃত কর-রাজস্ব দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য পানি ও পয়:নিষ্কাশন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি সেবা খাতে এমনভাবে বিনিয়োগ করবে যাতে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ধনী, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হয়।

তাই আমরাও গত কয়েক দিন যাবৎ ফেসবুক, এক্স/টুইটার এবং হ্যাসট্যাগ ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও তুলনামূলক পরিসংখ্যান দিয়ে দেশে দেশে এবং দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট ও ক্রমবর্ধমান অসমতার বিষয়ে সচেতনতা ও নাগরিক সমাজের মতামত তৈরীর চেষ্টা করছি।

তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিষয়ে যাওয়া ছাড়াও আমি আরও একটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। উন্নয়ন আন্দোলনে আমাদের নাগরিক সমাজ এবং অনেক এনজিওসমুহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুষ্পষ্ট নয় বলে মনে হয়। তাদের কাজের ধারা ও কৌশল দেশের আর্থ-সামাজিক কল্যান ও অসমতা দূরীকরনের লক্ষ্য অর্জনে কাংখিত সংগ্রামের সাথে কতটা সংগতিপূর্ন তা আজ প্রশ্নসাপেক্ষ। আজকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে তথাকথিত বাজার ভিত্তিক উন্নয়নের ধারনায় বিশ্বাসী দেশীয় বড় বড় এনজিও এবং আন্তর্জাতিকভাবে সৃষ্ট এনজিওসমূহ [INGOs ] কি আমাদের দেশে দেশে এবং সমাজের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসমতাকে উৎসাহ দিচ্ছে? কারন এ বিষয়ে বৈশ্বিকভাবেও একটা দাবী রয়েছে যে, আন্তর্জাতিক এনজিওসমুহ, বহুজাতিক কোম্পানীসমুহের প্রধান নির্বাহীদের বেতন একটা স্তরে সুনিদিৃষ্ট করা এবং এর সর্বচ্চো সীমা বেধেঁ দেওয়া। বাংলাদেশে দাতা সংস্থার প্রকল্প কর্মীদেরকে দেশীয় স্থানীয় এনজিওতে কর্মরত কর্মীদের চাইতে বহুগুন বেশী বেতন দিতে হচ্ছে। প্শ্ন হচ্ছে, মানব সম্পদ ব্যবস্থপনায় এটা কি টেকসই এবং সুস্থ্য প্রতিযোগীতা? আমরা কি একটা অসম ভোগবাদীতাকে উৎসাহ দিচ্ছি এবং এক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ন্যয্যতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরনে আমাদের প্রতিশ্রুতি কোথায়?

উচ্চ বেতনে পেশাদার এবং অভিজ্ঞ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে স্থানীয় এনজিও এবং দেশীয় বড় এনজিও ও আন্তর্জাতিকভাবে সৃষ্ট এনজিওগুলোর মধ্যে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগীতা চলছে। দেশের বড় এনজিও, কিছু আন্তর্জাতিক এনজিও এবং দাতা সংস্থা এ ধরনের অসুস্থ প্রবনতাকে উৎসাহ দিচ্ছে এবং দেশের মধ্যে একক এনজিও-মনোপলি সৃষ্টি করছে যা কাম্য নয়। এটা আমাদের সমাজে কোন প্রকার সামাজিক ভারসাম্য তৈরী করছে না বরং একটি শ্রেনির হাতে ক্ষমতা ও অর্থ পুঞ্জিভূত করতে সহায়তা করছে, বিশেষ করে কক্সবাজার অঞ্চলে রোহীঙ্গা রেসপন্স কর্মসুচির ক্ষেত্রে যা খুবই আশংকাজনক।

রেজাউল করিম চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ফাউন্ডেশন।