নাগরিক সমাজ/সিভিল সোসাইটি মানে, যে এনজিও বা অন্যান্য সংস্থা যারা মানবাধিকার (শরণার্থী অধিকার সহ) পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। যে এনজিও বা নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটি শুধুমাত্র সেবা সরবরাহ করে কিন্তু মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেনা তাদেরকে নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটি বলা ঠিক হবে না। নাগরিক সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, এরা সর্বদাই বিশ্লেষণাত্নক হয়, কোনভাবেই চাটুকারিতা করে না। যেহেতু কক্সবাজারে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে, তাই সেখানে এইধরনের একটি নাগরিক সমাজের ভিত্তি গড়ে তোলা উচিত, যা মানবাধিকার এবং একটি বহুত্ববাদী সমাজের পক্ষে দাঁড়াবে।
দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গা রেসপন্সের জন্য এনজিওদের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছিলো, অবশ্য এই ব্যাপারে এনজিওগুলির কাছ থেকেও একটি দাবি ছিল, বিগত তিন বছর আগে সম্ভবত ২০২১ সালের দিকে এটা হয়ে থাকতে পারে। এই প্রক্রিয়ার গোড়া থেকেই আমার সম্পৃক্ততা ও সমর্থন ছিলো। যদিও আমরা সিসিএনএফ করেছি তথাপি আমরা এখনো প্ল্যাটফর্মের পক্ষে। খুব একটা সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য না থাকলেও এটা বলা হয়েছিলো যে, জাতীয় ও স্থানীয় এনজিওগুলির সাথে জাতিসংঘের সংস্থা ও আইএনজিওগুলির উপস্থিতি হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ। এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকে সুবিন্যস্ত করতে হবে। প্ল্যাটফর্ম হোস্টিং সংস্থা সম্প্রতি অন্য আর একটি আইএনজিও-তে স্থানান্তরের প্রাক্কালে একটি এক্সটারনাল মূল্যায়ণের ব্যবস্থা করেছে। যেহেতু হোস্টিং সংস্থা এক্সটারনাল মুল্যায়ণের জন্য একজন কনসালটেনটকে নিয়োগ করেছে, সেহেতু এবং সাধারনত এই ধরনের মুল্যায়নে খুব বেশি একটা সমালোচনা আসবেনা। এই ধরনের মূল্যায়ণ হয় অনেকটা সেলফ সার্টিফিকেট প্রদানের মতো।
কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মটি কি রোহিঙ্গা রেসপন্সে কোনো প্রকার ভারসাম্য তৈরিতে সফল হয়েছে, খুবই কম। তহবিলের প্রায় ৮০% জাতিসংঘের সংস্থাগুলো কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে, এবং প্রায় সকল সিদ্ধান্তই ইন্টার সেক্টরাল কোঅর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) এবং জাতিসংঘের বিদেশী কর্মকর্তাদের দ্বারা নেওয়া হচ্ছে। গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় (বিশেষ করে সহায়তার সঙ্কুচিত মাত্রা মেটাতে), আইএসসিজি, আইএনজিও এবং জাতিসংঘের অফিসসমূহে বাংলাদেশি এবং কক্সবাজারের স্থানীয়দের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা খুবই কম। তাদেরকে স্থায়িত্বশীল,দায়বদ্ধ, জবাবদীহিতা ও সুশাসন সম্পন্ন স্থানীয় সিভিল সোসাইটি কিভাবে গড়ে তুলতে হয় সেই বিষয়ে কোন প্রশিক্ষন দেয়া হয়নি বা কোন নীতিমালাও জানানো হয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। যদিও সকল জাতিসংঘের সংস্থাসমূহ এবং আইএনজিওসমূহ স্থানীয় সিভিল সোসাইটি গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞবদ্ধ।
কক্সবাজারে এখন কত এনজিও প্লাটফর্ম-এর সদস্য রেসপন্স প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত বা কাজ করছে? কতজন এনজিও সদস্য কার্যত বিদ্যমান? শুধুমাত্র সরকারি/সমাজ কল্যাণ-এর নিবন্ধন থাকলেই কি সিভিল সোসাইটি হয়ে যায়? কতজন এনজিও সদস্যের, যাদের নাগরিক সমাজের সক্রিয়তার অতীত ভূমিকা রয়েছে? তারা কি শুধুমাত্র তহবিল পাওয়ার আশায় এনজিও গঠন করেছেন! প্রতিনিধিত্ব এবং নেতৃত্বের কাঠামো ইতিমধ্যেই অলিগার্কিতে ভুগছে, অর্থাৎ, একদল লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এবং তারাই বারবার নির্বাচিত হচ্ছেন, এবং এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যে ভবিষ্যতে তারা বা তাদের লোকজন নির্বাচিত হবেন।
আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, আমাদের সুদক্ষ আমলাতন্ত্রের মতো প্ল্যাটফর্মের ও একটা দক্ষ সচিবালয় রয়েছে। কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতো নির্বাচিত নেতৃত্বের মধ্যে কিছু ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। গুণগত দিকনির্দেশনার সক্ষমতার ক্ষেত্রে; সুদক্ষ দাতা, জাতিসংঘ, আইএনজিও এবং সরকারী নীতি নির্ধারকদের সামনে আলাপ-আলোচনায় আমাদের প্ল্যাটফর্মের নির্বাচিত নেতাদের জ্ঞানভিত্তিক নেগোসিয়েশনে আরো আধুনিক ও অতিসাম্প্রতিক হতে হবে, তারা কি সেটার জন্য চেষ্টা করছেন? এই বিষয়গুলো অবশ্যই পুনরায় পরীক্ষা করা এবং চ্যালেঞ্জ করা উচিত যদি বিদ্যমান এই কাঠামোটিকে কার্যকর করতে হয়। বিনিয়োগকৃত অর্থের মূল্য এবং ফলাফল-ভিত্তিক হতে হয়।
কক্সবাজারে মানবাধিকার ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা কতটুকু? এমন সব ঘটনা রয়েছে যে প্ল্যাটফর্ম স্থানীয় নেতৃত্ব সম্পন্ন, স্থায়ীত্বশীলতা এবং সক্ষমতার সাথে গড়ে উঠা সংগঠন ও নেতৃত্বকে চরম অবহেলাভারে এবং অপমান করে দূড়ে ঠেলে দিয়েছে । যেখানে স্থানীয়ভাবে সিভিল সোসাইটি গড়ে তোলার জন্য একে অন্যের সহযোগিতা ও ঐক্যের প্রয়োজন সেখানে এই বিভাজন এবং দূড়ে সরিয়ে রাখার সংস্কৃতি কোনভাবেই কাজ করতে পারেনা। বরং তারা সমগ্র রোহিঙ্গা রেসপন্স ব্যবস্থাপনায় একটি একক এনজিও’র (একটি জাতীয়ভাবে উদ্ভব আইএনজিও) একচেটিয়াকরণকে প্রমোট করছে, যা আমাদেরকে একটি আত্নসম্মানহীন ও নির্ভরশীলতার সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
প্রকৃত কারণগুলো চিহ্নিত করে মানবাধিকার ও জবাবদিহিতার চর্চার উন্নয়নে, প্রচারনা এবং অ্যাডভোকেসি অতিব গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিকভাবে সিভিল সোসাইটিকে একত্রিত করে মায়নমারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার জন্য অ্যাডভোকেসি করার প্রয়োজন সর্বাগ্রে আসতে হবে। অথচ এই দুটি বিষয়ে প্ল্যাটফর্মের দৃষ্টিভঙ্গি আগ্রহহীন এবং উদাসীন। এক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মের সদস্য আন্তর্জাতিক এনজিও ও জাতীয় এনজিওগুলোর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
রেজাউল করিম চৌধুরী
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।