তাওহীদুল ইসলাম নূরী :

এক সময় সাংবাদিক হওয়ার বড় স্বপ্ন ছিল। যখন কোথাও কোন ভদ্রলোক পত্রিকা পড়তেছে দেখলে কখন তার পত্রিকা পাঠ শেষ হবে এবং নিজে পত্রিকাটি পড়তে পারবে এ অপেক্ষায় মানুষ তার পিছনে লাইন ধরত। চার পৃষ্ঠার বেশি পৃষ্ঠার পত্রিকা পাঠ করতে দেখলে “আমাকে ভিতরের ৫/৯/১৩ পাতাটি দেন প্লিজ” বলতো। আমি যখন সবেমাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকে কক্সবাজারের স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে লিখালিখি করতাম। মাঝে মাঝে সমাজ ও এলাকার প্রয়োজনে নিউজ করার চেষ্টাও করতাম। প্রায় ১ ঘন্টা পায়ে হেঁটে শহরে গিয়ে কুরিয়ার সার্ভিস যোগে সংবাদপত্র অফিস বরাবর পাঠানো নিজের হাতে লিখিত কবিতা,প্রবন্ধ এবং নিউজগুলো কয়েক দিন পর পত্রিকার পাতায় দেখলে খুবই পুলকিত হতাম। সাংবাদিকদের কদর ছিল তখন খুব বেশি। সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একজন সাংবাদিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হত প্রায় মাস কিংবা সপ্তাহখানেক আগে থেকেই। একজন সাংবাদিককে দেখলে যে কেউ নিজের চেয়ারটা ছেড়ে দিত। কারণ, তখন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও অনেকে এই পেশাটা বেছে নিত দেশ-মাতৃকার কল্যাণে।

সময়ের ব্যবধানে আজকাল এই চিত্রের দেখা মেলে না। পথে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে সাংবাদিক পরিচয়ে সংবাদ ব্যবসায়ীদের ছড়াছড়ি! ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ হাসিলের জন্য নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলো তৈরি করেছে নাম সর্বস্ব অসংখ্য সাংবাদিক। সাংবাদিকের মূল কাজ কী কিংবা সাংবাদিকের সংজ্ঞাই বা কী সেটাও যাদের অনেকের কাছে হয়ত অজানা। ৮ম/৫ম পাস শুধু নয় নিরক্ষর অনেককেও সাংবাদিক সাজতে দেখার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আমি নিজেই। যাদের অনেকেই বিদেশে গিয়ে তেমন সুবিধা করতে না পেরে এই পেশায় এসেছেন, আবার অনেকে কোথাও কোন চাকুরী না পেয়ে গলায় একটি আইডি কার্ড ঝুলিয়ে মস্ত বড় সাংবাদিক সেজে গেছেন। অথচ, যারা তাদের আইড কার্ডগুলো প্রদান করে থাকে তারাও প্রকৃত সাংবাদিক নয়। এমন অহরহ নজির আছে। জন্ম-মৃত্যু সংবাদ, বিদেশ গমন, পদোন্নতি, অসুস্থতার সংবাদই যাদের কাছে সাংবাদিকের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে ঠেকেছে। ২০০/১০০ টাকার বিনিময়েও এসকল নিউজ করে সাংবাদিকতা এবং মিডিয়ার বারোটা বাজিয়েছে এরা। অথচ,দেশের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে চার বছরের অনার্স ও এক বছরের মাস্টার্স সম্পন্ন করার পরও প্রকৃত সাংবাদিক হওয়ার যারা স্বপ্ন দেখেন তাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরও অনেক সময় লেগে যায়। জাতীয় কিংবা স্থানীয় সকল নির্বাচনেই সাংবাদিক পরিচয়ের সংবাদ ব্যবসায়ীদের দেখা যায় একটা ভাল স্মার্ট ফোন নিয়ে প্রার্থীদের কথিত সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের কাছ থেকে ৫০০/১০০০ টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের পিছনে পিছনে ঘুরতে। নিজের ফেসবুক আইডি থেকে একটা থেকে পেইজ খুলে, এটাকে “অমুক টিভি/তমুক টিভি” এমন নাম দিয়েই মূলত তারা সাংবাদিক সাজেন। এরাই ৫০০/১০০০ টাকার বিনিময়ে তিলকে তাল, তালকে তিল করতে একটুও দ্বিধা করে না। সেজন্য এক সময় সমাজে সাংবাদিকদের যে মানসম্মান ছিল আজ তা এই সংবাদ ব্যবসায়ীদের কারণে অনেক ম্লান হয়ে আসছে। তাইতো, আমারও সাংবাদিক হওয়ার সেই ১৫ বছর আগের স্বপ্ন এখনও মাঝে মাঝে নিজের লিখিত প্রবন্ধ,কলাম এবং নিউজগুলো পত্রিকায় প্রকাশের আনন্দ তথা শখের মধ্যেই বন্দী হয়ে আছে।

সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। বিভিন্ন দেশে সাংবাদিক থেকে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হওয়ার নজির আছে। আমাদের দেশেও সাংবাদিক থেকে অনেকে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। এই পেশায় তাইতো শিক্ষিত,মেধাবী এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকদের এগিয়ে আসা জরুরি। যারা বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানী এবং গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবেন। জাতির কল্যাণ নিহিত এমন হরেক রকম উৎসের সন্ধান দিতে পারবেন। অন্যথায় সমাজ এবং দেশে সাংবাদিকদের মান এক সময় শূন্যের কোটায় চলে যাবে। সরকারকেও একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা, সম্পাদক, রিপোর্টার, প্রতিনিধি এবং যারাই পত্রিকার সাথে জড়িত থাকবে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে হবে। বর্তমানে যে নামসর্বস্ব প্রিন্টিং এবং অন-লাইন পত্রিকা ও অনলাইন টিভিগুলো দেখা যায় এগুলো বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর যারাই এই মহান পেশাটি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করে গণমানুষের মাঝে প্রকৃত সাংবাদিক এবং মিডিয়ার গুরুত্বকে ফিকে করে চলছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।

(মতামত একান্ত লেখকের ব্যক্তিগত)

লেখকঃ প্রাবন্ধিক,সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী। আইন বিভাগ(অধ্যয়নরত),আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।