মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
কক্সবাজারে শিশু সংবেদনশীল আদালত (এজলাস) এর যাত্রা শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তন থেকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এমপি ভার্চুয়ালী কক্সবাজার সহ দেশের ৯টি জেলায় ১০টি শিশু সংবেদনশীল আদালত কক্ষ (এজলাস) এর উদ্বোধন করেন।
আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো: গোলাম সারওয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশে ইউনিসেফের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ শেলডন ইয়েট। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ইউনিসেফ বাংলাদেশের চাইল্ড প্রটেকশন সেকশনের প্রধান নাতালি ম্যাককিল, বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব ও প্রকল্প পরিচালক শেখ হুমায়ুন কবির, রাজশাহী শিশু আদালত-২-এর বিচারক মুহা. হাসানুজ্জামান প্রমুখ।
ভার্চুয়ালী শিশু সংবেদনশীল আদালত (এজলাস) উদ্বোধন এর সময় কক্সবাজার প্রান্তে অনলাইনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিন। কক্সবাজারের শিশু আদালত ২ এবং ৩ এর বিচারক (জেলা জজ) যথাক্রমে মো: নুরে আলম এবং মোহাম্মদ আবু হান্নান এসময় বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ইউনিসেফ কক্সবাজার অফিসের চাইল্ড প্রটেকশন ম্যানেজার প্যাট্রিক হ্যালটন, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট একরামুল হুদা, ইউনিসেফ এর কর্মকর্তা শতাব্দী খাস্তগীর প্রমুখ ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কক্সবাজার প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশ কর্তৃক যৌথভাবে বাস্তবায়নাধীন স্ট্রেংদেনিং ক্যাপাসিটি অব জুডিশিয়াল সিস্টেম ফর চাইল্ড প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (এসসিজেএসসিপিবি) প্রকল্পের অধীনে এটি বাস্তাবায়িত হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, শিশুর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতের অঙ্গীকার বাস্তাবায়নে প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালের শিশু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করেছিলেন। শিশু সংবেদনশীল আদালত কক্ষ তার ধারাবাহিকতা। শিশু আইন ২০১৩ বাস্তবায়নে বিচারক ও সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়ানো হচ্ছে। এই আইন কার্যকরে এ জন্য পৃথক বাজেটও রাখা হয়েছে।
’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, শিশুদের অধিকার নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে দেশটি শিশু আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এ আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বাজেট থেকে অর্থায়ন। আশা করি সেটি নিশ্চিত করা হবে। সেই সঙ্গে আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে।
শিশু আইন ২০১৩ বাস্তাবায়নের লক্ষ্যে দেশের ৯ টি জেলায় ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ১০টি শিশু সংবেদনশীল আদালতের স্থায়ী এজলাস নির্মান করা হয়েছে। জেলা গুলো হচ্ছে-কক্সবাজার, জামালপুর, রাজশাহী (২টি), রংপুর, খুলনা, বরিশাল, বরগুনা, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম। শিশু সংবেদনশীল আদালতের এজলাস গুলো শিশু আইন অনুযায়ী নির্মিত দেশের প্রথম স্থায়ী শিশু আদালত।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালত ভবনের তৃতীয় তলার দক্ষিণ-পূর্ব কর্ণারে শিশু সংবেদনশীল আদালতের নতুন এজলাসটি গড়ে তোলা হয়েছে।
শিশু সংবেদনশীল আদালতের এজলাসটি লালসালু ঘেরা প্রচলিত বিচারিক এজলাস নয়। সেখানে নেই, আসামী ও সাক্ষীর কাঠগড়া। স্বাভাবিক এজলাসের মতো বিচারক বসবেন না। পুলিশ ও আইনজীবী সহ দাপ্তরিক ও পেশাগত ড্রেসে এজলাসে কেউ থাকবেন না। সাধারণ ডিম্বাকৃতির ডাইনিং টেবিলের মতো অনেকটা ঘরোয়া ও ভীতিহীন পরিবেশে বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, আইনের সাথে সাংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিশু, মামলার সাক্ষী, শিশুর অভিভাবক, আদালতের স্টাফ সহ সংশ্লিষ্ট সকলে শিশু বান্ধব পরিবেশে উপস্থিত থেকে বিচারকার্য পরিচালনা, জবানবন্দি প্রদান ও গ্রহণ, প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দায়িত্ব পালন করবেন।
কক্সবাজারের শিশু আদালত-২ এর জ্যেষ্ঠ বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ শামীম জানান, তিনটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের শুধুমাত্র শিশু মামলাগুলো বিচারের জন্য প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন করে উদ্বোধন হওয়া শিশু আদালতের এজলাস পরিচালনা করার প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নতুন শিশু সংবেদনশীল আদালত যেদিন চলবে, সেদিন উক্ত আদালতে আর অন্য কোন মামলা পরিচালনা করা হবেনা।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জেলা নাজির বেদারুল আলম জানান, শিশু সংবেদনশীল আদালতের নতুন এজলাস পরিচালনায় কক্সবাজার জজশীপ থেকে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিন এর নির্দেশনায় সম্ভব সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
শিশু বান্ধব পরিপূর্ণ শিশু আদালতের স্থায়ী এজলাস উদ্বোধন প্রসংগে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ বলেন, এ আদালতে সহজ ও সুন্দরভাবে ভীতিহীন পরিবেশে আইনের সাথে সাংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিশুদের বিচারকার্য পরিচালনা করা যাবে। তিনি আরো বলেন, এতে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে শিশুদের বিচারকাজ না হওয়ায় শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। ফলে আগামী দিনের কান্ডারি শিশুরা ইতিবাচক ও গঠনমূলক চিন্তা করতে পারবে।
কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট একরামুল হুদা বলেন, শিশু বান্ধব পৃথক এজলাসে শিশুদের বিচারকার্য পরিচালনায় সরকার ও ইউনিসেফ এর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে পাইলট প্রকল্পের আওতাধীন ৯টি জেলায় ১০ টি সর্বপ্রথম শিশু বান্ধব স্থায়ী এজলাসের কার্যক্রম শুরু হলো।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম ছিদ্দিকী বলেন, শিশু সংবেদনশীল পৃথক এজলাসে বিচারকাজ চললে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন খুন, ধর্ষণ, অপহরণ সহ অন্যান্য মামলার আসামিদের সংস্পর্শে আসবেনা, আইনের সাথে সাংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিশুরা। তিনি আরো বলেন, আগে দেশে কোন কোন জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে শিশু আদালত পরিচালনা করা হলেও সেটা অস্থায়ী এজলাসে সাময়িকভাবে করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার উদ্বোধন হওয়া নতুন শিশু সংবেদনশীল আদালত দেশের বিচার ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাওহীদুল আনোয়ার বলেন, শিশু আইনে শিশুদের বিচারকার্য পরিচালনায় আদালতের এজলাস কি ধরনের হওয়া উচিত, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতদিন কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল এ নিয়ম। ফলে বড়দের মতো শিশুদের বিচার হতো প্রচলিত আদালতে। অথচ শিশু যাতে বুঝে উঠতে নাপারে, তাকে আদালতে হাজির করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে বিচারকার্য চলছে-এরকম ভীতিহীন, শিশুবান্ধব এজলাসের কথা শিশু আইনে উল্লেখ রয়েছে। অ্যাডভোকেট তাওহীদুল আনোয়ার বলেন, দেশের ৯টি জেলার মতো ধীরে ধীরে সব জেলাতে শিশু সংবেদনশীল আদালতের পৃথক স্থায়ী এজলাস গড়ে তোলা উচিত।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সহ সাধারণ সম্পাদক (সাধারণ) মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বলেন, আইনসম্মতভাবে গড়ে তোলা শিশু আদালতে শিশু–কিশোরদের বিচার করা হলে ভবিষ্যতে নতুন করে অপরাধে না জড়াতে শিশুরা উদ্বুদ্ধ হবে। তিনি আরো বলেন, ধীরে ধীরে দেশের সব শিশু আদালতের এজলাস এভাবে গড়ে তোলা উচিত। এতে শিশুরা ভীতিহীন পরিবেশে আইন সম্পর্কে অবহিত হবে এবং দ্রুত সংশোধনের সুযোগ পাবে।
কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বেঞ্চ সহকারী উজ্জ্বল হোসেন জানান, নির্মাণাধীন শিশু আদালতের নতুন এজলাসে শিশু মামলা গুলোর বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় তারা প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। শিশু আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মতো এ বিষয়ে তাঁরা যাবতীয় কাজ গুছিয়ে নিয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। যাতে, উদ্বোধন হওয়া নতুন শিশু সংবেদনশীল আদালতে সাবলীল ও সুন্দরভাবে শিশু মামলা গুলোর বিচার কাজ পরিচালনা করা যায়।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।