সুজাউদ্দিন রুবেল :
সাগরপাড় ঘেঁষে দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভকে দৃষ্টিনন্দন ও নান্দনিক করতে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী। প্রশস্তকরণের পাশাপাশি সমুদ্রের আগ্রাসন থেকে একে রক্ষা নির্মিত হচ্ছে সি-ওয়াল। আর যানজট এড়াতে রেজুখালে চার লেনের দৃষ্টিনন্দন সেতু নির্মাণের পাশাপাশি পুরো মেরিন ড্রাইভের নিরাপত্তায় বসছে ৬০৮টি সিসিটিভি ক্যামেরা। এর মাধ্যমে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার-টেকনাফ দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটার এ মেরিন ড্রাইভ। এর রেজুখালে রয়েছে সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতু। এ সেতুর দুপ্রান্তে সবসময় লেগে থাকে দীর্ঘ যানজট। আর শুক্রবার-শনিবার হলে এ যানজট বেড়ে যায় বহুগুণে। যার কারণে দুর্ভোগের শেষ থাকে না ভ্রমণপিপাসু, যাত্রী ও চালকদের।

এবার সেই দুর্ভোগ লাঘবে মেরিন ড্রাইভের রেজুখালে নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন চার লেনের সেতু; এর দুপ্রান্তে থাকছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। থাকছে রেস্তোরাঁ, পর্যটকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা ও হাঁটার জন্য আলাদা লেন। এর মধ্যে নদীশাসন ও পিলার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

বর্ষা মৌসুম আসলেই মেরিন ড্রাইভের নানা অংশে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়। এ ভাঙন রোধে এবার নির্মাণ করা হয়েছে সি-ওয়াল। একই সঙ্গে চলছে সিসি ব্লক স্থাপন ও ট্রেটাপড নির্মাণ। এর মধ্যে মেরিন ড্রাইভের কলাতলি অংশে শুরু হয়েছে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ। সড়কটি ১৮ ফুট থেকে করা হচ্ছে ৩৩ ফুটে। একই সঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি চলছে মাটি ভরাটের কাজ। সব কাজই চলছে জোরেশোরে। যাত্রী, চালক ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, যানজট দূর হওয়ার পাশাপাশি নানান কারণে পর্যটকরা এ মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণ করতে পারবেন স্বাচ্ছন্দ্যে।

রেজুখালের বাসিন্দা ওসমান বলেন, খালের ওপর সেতুটি সরু আর ঝুঁকিপূর্ণ। এতে সেতুটির দুপ্রান্তে ৩ কিলোমিটার করে ৬ কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট লেগে যায়। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় করতে হয়। আর পর্যটন মৌসুমে শুক্রবার বা শনিবার হলে তো কথায় নেই! ওই দিনগুলোতে যানজট বেড়ে যায় আরও বেশি।

মেরিন ড্রাইভে চলাচলকারী ইজিবাইক চালক রিদুয়ান করিম বলেন, পর্যটক থাকলে যানজট বেশি হয়। এই রেজুখালের সেতুটি নতুন করে হচ্ছে — এতে আমরা খুবই খুশি। আর যানজটে পড়তে হবে না; দ্রুত রেজুখাল পেরিয়ে পর্যটকদের নিয়ে ইনানী ও পাতুয়ারটেক যেতে পারব।

পর্যটন ব্যবসায়ী সোয়েব বলেন, মেরিন ড্রাইভ প্রশস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি রেজুখালের সেতুটিও নতুন করে হচ্ছে। খুবই ভালো লাগছে। তার চেয়ে বেশি ভালো লাগছে কাজটি সেনাবাহিনী করছে। এতে করে কাজ দ্রুত শেষ হবে এবং কাজও টেকসই হবে।

প্রথম পর্যায়ে ১২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেরিন ড্রাইভের কলাতলির পর থেকে পাতুয়ারটেক পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার প্রশস্ত হচ্ছে। যার মধ্যে ৪০০ কোটি ব্যয় হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণে; আর বাকি ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে সেতু নির্মাণ ও ভাঙন রোধসহ নানা কাজে।

কক্সবাজারস্থ সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহে আরেফীন বলেন, ১২০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণে এবং বাকি ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে রেজুখাল ব্রিজ এবং ছোট-বড় ব্রিজ নির্মাণসহ বিভিন্ন পয়েন্টে সমুদ্রের আগ্রাসন থেকে সড়ক সুরক্ষায় বাঁধ নির্মাণ।

প্রকৌশলী শাহে আরেফীন বলেন, মেরিন ড্রাইভ এখন ১৮ ফিট থেকে ৩৩ ফিটে উন্নীত করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ১১৩.২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে; সাত লাখ ২৪ হাজার ঘনমিটার মাটি ভরাট কাজ চলছে; ২৯. ৪২ কিলোমিটার ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট প্রশস্তকরণ ও ০.৩২ কিলোমিটার ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট বাঁক সরলীকরণ কাজ।

শাহে আরেফীন আরও বলেন, ৬ হাজার ৪৮০ মিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ৬৩ হাজার ৭২০ বর্গমিটার জিও টেক্সটাইলসহ সিসি ব্লক স্থাপন, ৫৪ হাজার ৩৬০টি টেট্রাপড নির্মাণ, ৯ হাজার ১২০ বর্গমিটার রোড মার্কিং, ইউটিলিটি স্থানান্তর, রেজুখালের ওপর দুলেনের একটি সেতু নির্মাণ (৩০৫ মিটার) এবং মেরিন ড্রাইভের নিরাপত্তায় ৬০৮টি সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। একই সঙ্গে ৯ হাজার ১৮০ মিটার এল ড্রেন ও ১৩ হাজার ৯৪ মিটার ইউ ড্রেনের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাও নির্মাণ করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ইনানীতে এক ফায়ারিং অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মেরিন ড্রাইভের কাজ চলমান রয়েছে। সরকারের যে পরিকল্পনা আছে সেটা বাস্তবায়নের জন্য যে দায়িত্ব দেয়া হবে, তা আমরা স্বল্প বাজেটে স্বল্প সময়ের মধ্যে করে দিতে সক্ষম। পরিকল্পিতভাবে একটা রূপরেখা বাস্তবায়ন হয় সেটা অবশ্যই সৌন্দর্য এবং নান্দনিক হবে বলে বিশ্বাস করি। যত্রতত্রভাবে রাস্তা যাওয়া, যেখানে-সেখানে বাড়িঘর হওয়া এটা সৌন্দর্যকে নষ্ট করে। আমরা যেটা করছি, এটা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। আর পরিকল্পিতভাবে হলেই দৃষ্টিনন্দন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে। এই মেরিন ড্রাইভের ফলে জনগণ এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অনেক সুবিধা হবে বলে বিশ্বাস করি।

২০২২ সালের ২৮ জুন প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। এ মেরিন ড্রাইভ প্রশস্তকরণের মাধ্যমে নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা, পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং প্রকল্প এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে বলে আশা করছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
– সময়নিউজ