কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম (সিবিআইএফ) এর উদ্যোগে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো প্যাসিফিক এফেয়ারস (বিসিআইপিএ’র) সহ যৌথভাবে গত ২৭ এপ্রিল রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে একটি আন্তর্জাতিক সংলাপের আয়োজন করে যার বিষয়বস্তু ছিল – “সম্প্রীতির সেতু নির্মাণ: গৃহযুদ্ধ পরবর্তী আরাকান/রাখাইনে সামাজিক সংহতি, শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য সামগ্রিক কৌশল’। প্রায় আড়াই ঘন্টাব্যাপী এই সংলাপে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও মিয়ানমারের অভিজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গবৃন্দ অংশ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, এই আলোচনায় মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) এর দায়িত্বশীল মন্ত্রীবর্গও সংযুক্ত ছিলেন। আলোচনার শেষ দিকে মুক্ত আলোচনায় হোস্ট কম্যুনিটির বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ এবং সীমান্তে এর প্রভাব, গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ সহ সার্বিক বিষয়ে পারস্পরিক সংলাপের মধ্য দিয়ে আলোচনাটি প্রাণবন্ত ও সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠে।
আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজুর রহমান (অব.), সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল শহীদুল হক (অব.), সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাখাওয়াত হোসেন (অব.),আরাকান অ্যালায়েন্স (এআরএনএ) চেয়ারম্যান জনাব নুরুল ইসলাম, মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) মানবাধিকার উপমন্ত্রী জনাব অং কিয়াও মো, ফেডারেল ইউনিয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ডক্টর লিয়ান হামুং সাখং, রিচার্ডসন সেন্টার ফর গ্লোবালের সিনিয়র উপদেষ্টা স্টিভ রস, বিসিআইপিএ প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ডাঃ শাহাব এনাম খান, হোস্ট কম্যুনিটির পক্ষে ব্যারিস্টার মিজান সাইদ আলোচনায় অংশ নেন। তাছাড়া প্রখ্যাত নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।
এশিয়ার শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে ভারত ও চীন উভয়ের জন্য রাখাইন রাজ্যের কৌশলগত গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে আলোচনা শুরু করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজুর রহমান (অব.)। রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন।
মেজর জেনারেল শহিদুল হক রাখাইন সংঘাতের মূল কারণগুলি আলোকপাত করে ফিলিস্তিনের সাথে আরাকানকে তুলনা করেন। তিনি ঐতিহাসিক পটভূমিতে আলোকপাত করে আজকের মায়ানমারের সংকটের নেপথ্যে তিনটি মূল কারণ চিহ্নিত করেন: ইতিহাসের ব্যাখ্যা, জনসংখ্যার পরিবর্তন এবং প্যাংলং চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা।
রিচার্ডসন সেন্টার ফর গ্লোবালের সিনিয়র উপদেষ্টা স্টিভ রস রাখাইনে সামাজিক সংহতির তাৎপর্য এবং সামগ্রিকভাবে মিয়ানমারের জন্য এর প্রভাব সম্পর্কে তার বিশেষজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি রাখাইনে ব্যাপক নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, চরম রাজনৈতিক প্রান্তিকতা, দারিদ্র্য এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিয়োজিত বিভক্তি-এবং-শাসন কৌশলকে সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন।
মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) মানবাধিকার উপমন্ত্রী অং কিওয়া মো রাখাইন রাজ্যে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন। তিনি ১৯৪২ সালের সংঘাত থেকে ১৯৬২, ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১০ সহ বিভিন্ন বছর ধরে রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক, রাষ্ট্র-মদতপ্রাপ্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ধারাবাহিক তথ্য তুলে ধরেন এবং ২০১৭ সালে রাজনৈতিক লাভের জন্য সামরিক সরকার কর্তৃক রাজনীতি এবং ইসলামোফোবিয়ার কথা উল্লেখ করেন। তিনি রাখাইনে সামাজিক সংহতি প্রচারের মডেল হিসেবে বাংলাদেশের কক্সবাজার যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সহাবস্থান থেকে পাঠ আঁকার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। মো দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশি জনগণ ও সরকারের উদারতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমারে সংঘটিত জাতিগত নির্মূল ও গণহত্যার কথা স্বীকার করে ফেডারেল ইউনিয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ডক্টর লিয়ান হামুং সাখং বর্তমান নাগরিকত্ব আইন বাতিল করা সহ সামরিক শাসন উৎখাতের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। ডঃ সাখং সামরিক শাসনকে উৎখাত করে গণতান্ত্রিক ও ফেডারেলিস্ট নীতির মাধ্যমে মিয়ানমারের পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক আলতাফ পারভেজ পরিচয়ের রাজনীতির পরিবর্তে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনের উল্লেখ করেন ও বাংলাদেশে এএফপি ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলম এই সমস্যাকেন্দ্রিক ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক মানের মিডিয়া আউটলেট প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন (অব.) বাংলাদেশ সরকার রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে আরাকান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য ভূমিকা বিবেচনা করে আলোচনা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন । আয়োজক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার মিজান সাঈদ আয়োজক সম্প্রদায়ের দুর্ভোগ এবং সংলাপের গুরুত্বের ওপর জোর দেন।
এই আন্তর্জাতিক সংলাপে গুরুত্ব পেয়েছে রাখাইনে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মূল কারণ নির্ণয়, তৃণমূলে পুনর্মিলন প্রচেষ্টার তাৎপর্য্যকে জোর দেওয়া, ক্রমাগত সংলাপ অব্যাহত রাখা, মানবিক সহায়তা প্রদানের গুরুত্ব অনুধাবন করানো , বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি (আইডিপি) এবং পুনর্বাসন, জীবিকা সহায়তার জন্য তাদের চাহিদা পূরণ করা,আন্তঃজাতিগত বোঝাপড়া, সহনশীলতা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা। একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে সমাধানকল্প রচিত হতে পারে বলে আলোচকরা আন্তর্জাতিক এই সংলাপে অভিমত দেন।
উল্লেখ্য, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম (সিবিআইএফ) কক্সবাজারের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের জন্য কাজ করে থাকে যার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক এই সংলাপের আয়োজন করা হয়। ভবিষ্যতে ইন্দো প্যাসিফিক বিষয়ক আলোচনা , আরাকান দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য আরও সংলাপ অব্যাহত রাখা এবং নীল অর্থনীতি , বঙ্গোপসাগর নিয়ে সংলাপ , অপতথ্যের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা নিয়ে কাজ করে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম- সিবিআইএফ।
(লেখাটি কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ফোরামের পক্ষ থেকে সমন্বয় করেছেন সিবিআইএফ এর যুগ্ম-আহবায়কবৃন্দ যথাক্রমে মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম, সারজিল আহসান, আদিল মাহমুদ ও সিনিয়র সদস্য যথাক্রমে সুজন শর্মা ও ইমরুল হাসান।)