রশীদ আহমদ চৌধুরী

দেশে ক্রমবর্ধমান তীব্র মূল্যস্ফীতির কারনে নিম্ন আয়ের সাধারণ জনগোষ্ঠির পাশাপাশি মধ্য বিত্তের জীবন ও ক্রমশ: দূর্বিসহ হয়ে উঠছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিদিন তার প্রতিফলন দৃশ্যমান। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য এযাবৎ গৃহিত প্রায় সব পদক্ষেপ কার্যকর না হবার কারনে এটি জনজীবনে জেঁকে বসেছে এবং দিন দিন প্রলম্বিত হচ্ছে। গত অর্থ বছরের প্রায় অংশজুড়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে ছিলো। চলতি অর্থ বছরেও এ বৃদ্ধির প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। দেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনর শুরু হয় নব্বই দশকে, ব্যক্তিখাত ও শিল্পের বিকাশের ফলে অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বিকাশ শুরু হয়। ওই দশকে মূল্যস্ফীতি থাকলেও তা তেমন দীর্ঘ স্থায়ী না হওয়ার কারনে জনজীবনে তেমন প্রভাব ফেলেনি। পরের বছর তা কমে যায়। ওই দশকে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিলো ১৯৯৪-৯৫ অর্থ বছরে ৮.৮৭%। সর্বনিম্ন ছিলো ১৯৯২-৯৩ অর্থ বছরে ২.৭৪%। এর পরের দশকের শুরুতে ২০০০-২০০১ অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি ছিলো ১.৯৪%। তখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিলো ২০০৭-২০০৮ অর্থ বছরে ৯.৯৩%। চলতি দশকে দুই অর্থ বছরে ২০২০-২০২১
ও ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে যথাক্রমে ৫.৫৬% ও ৬.১৫% শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এসে তা দাড়ায় ৯.০২%। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের প্রথম ৮ মাস জুড়ে মূল্যস্ফীতি ৯% উপরে ছিলো ,ওই সময়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির চিত্র নিম্নরুপ ১। জুলাই -৯.৬৯% ২,আগষ্ট – ৯.৯২% ৩। সেপ্টেম্বর -৯.৬৩% , ৪। আগষ্ট -৯.৯৩% ৫। নভেম্বর -৯.৪৯% ৬।ডিসেম্বও ৯.৪১% ৭। জানুয়ারী -৯.৮৬% ৮। ফেব্রুয়ারী – ৯.৬৭% ফেব্রুয়ারীতে খাদ্যপণ্য মূলস্ফীতি ছিলো ৯.৪৪% ও খাদ্যবর্হিভূত পন্যের মূল্যস্ফীতি ছিলো-৯.৩৩%। বর্তমান উচ্চ বর্ধমান মূল্যস্ফীতির পেছনে দেশীয় কারনের চেয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে দায়ী করছে সরকার।

বলা হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, জ¦ালানী বাজারে অস্থিরতা ,ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশে^ মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করে। এরপর বিশ^বাজারে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। তথাপি বাংলাদেশের বাজারে এর কোন পজিটিভ প্রভাব দেখা যায়নি। এক পর্যায়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে আসতে শুরু করলেও বাংলাদেশে এর সম্পূর্ন ভিন্ন চিত্র।

২০২২ সালে আমেরিকার মূল্যস্ফীতি ৯.৬% এর উঠে গিয়েছিল। এরপর থেকে সেটা ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হয়। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারীতে তা নেমে হয়েছে ৩.১৫%। যুক্তরাজ্যে ৩.৪%, জার্মানে ২.৫% নেমে আসে। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ছিলো ২০২২ সালে ৬৭.৪% গত ফেব্রæয়ারীতে তা ৫.৯% নেমে আসছে। অথচ আমাদের দেশে গত ফেব্রুয়ারীতে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৯.৬৭%। বিশেষজ্ঞদের মতামত হচ্ছে বিশে^র যে সকল দেশে মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বগতি হয়েছে তারা সেটি নিয়ন্ত্রনের জন্য তড়িৎ কার্যকরি ব্যবস্থা নিয়েছে। পলিসি রেট ও লেন্ডিং সুদের হার দ্রুত সমন্বয় করে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তারল্য সরবরাহে। দেশে সুদের হার দ্রæত সমন্বয় করা হয়নি। ডলার বিনিময় হারও কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়। পরবর্তীতে সুদের হার ও বিনিময় হার সমন্বয় করা হলেও মূল্যস্ফীতি রোধে তা কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। এর মধ্যে রমজান মাস শুরু হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের গলাকাটা মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিতে আগুনে ঘি ঢালার মতো হয়েছে। আমাদের দেশ আমদানি নির্ভর দেশ। খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে শিল্পের কাচাঁমাল বাইরের থেকে আমদানী করতে হয়। বিশ^বাজারে পণ্য মূল্য ও ডলারের বিনিময় হার পন্যমূল্য নির্ধারনে প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। সুদের হার ও মুদ্রা বিনিময় হার সমন্বয় করে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি শতভাগ কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রন করা যায় না।
মুক্তবাজার অর্থ ব্যবস্থায় সরকার বাজার ব্যবস্থাপনায় রেফারি হিসেবে কাজ করবে। বাজারের স্টক হোল্ডার হচ্ছে উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী ও ভোক্তা। সরকার উল্লেখিত অংশিজনের মধ্যে দক্ষতার সাথে সমন্বয় করে বাজারকে সকলের জন্য কল্যাণকর করবে।মূল্যস্ফিতিকে সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনবে। আর এ ব্যবস্থা দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে বিশ্বের
অনেক দেশ উন্নতির চরম শিখরে উপণিত হয়েছে । অথচ দু:খজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে এই বাজার ব্যবস্থা সাধারণ জনগণের শোষনযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তাহার অন্যতম কারন হল রেফারী নিজেই খেলায় অংশ নিয়েছেন।
আমাদের দেশের অধিকাংশ (৬০%) মন্ত্রি, উপমন্ত্রি ও সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী শিল্পপতি। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। যার ফলে বাজারের রুল অফ গেমস ভেঙ্গে গেছে।বাজারে শৃঙ্খলা না থাকার কারনে মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রনের জন্য সরকার গৃহিত সব ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। যার ফল স্বরুপ ক্রমবর্ধমান গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল্যস্ফিতি। যার অসহায় শিকার এদেশের খেটে খাওয়া নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেনী। সম্প্রতি আইএমএফ এর চাপে সরকার ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার অবমূল্যায়ন করে ৭ টাকা হ্রাস করে ১১৭ টকা করা হয়েছে । স্মার্ট পদ্ধতি থেকে সরে এসে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করেছে । সুদে হার ৯/৬ থেকে বাজার ভিত্তিক করা হয়েছে । ফলশ্রতিতে আমদানী খরচ বৃদ্ধি পেয়ে তা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব বিস্তার করেছে । খাদ্যমূল্য স্ফীতি ১৫% অতিক্রম করেছে । স্বল্প সময়ে মানুষের আয় সে পরিমান বাড়েনি । যার ফলে জনগনের ভোগানিÍ বেড়েছে । সুদহার বুদ্ধির ফলে কস্ট অব ক্যাপিট্যাল বাড়বে যার ফলে বিনিয়োগ কমবে । কর্ম সংস্থান হ্রাস পাবে । প্রবৃদ্ধি গতি মন্তর হবে ।

লেখক:

রশীদ আহমদ চৌধুরী

আয়কর আইনজীবী