সিবিএন ডেস্ক:
‘কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিন, ভোটচোর ধরিয়ে দিন’— এমন লেখায় একটি পোস্টার চোখে পড়ছে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারে পিলারে। শুধু এক্সপ্রেসওয়ে নয়, পোস্টারটির দেখা মিলেছে বন্দর-পতেঙ্গা-ডবলমুরিংসহ পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চট্টগ্রাম-১১ আসনের নির্বাচনী এলাকায় বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম এ লতিফের সৌজন্যে এসব পোস্টার সাঁটানো হয়েছে।

পোস্টারটি বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, কাদের ইঙ্গিত করে এমন পোস্টার সাঁটানো হয়েছে? অথবা হঠাৎ করে কেনই বা পোস্টারে এমন বার্তা?

ওই আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য এম এ লতিফের সঙ্গে এবার নির্বাচিনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া তেমন কোনো ‘হেভিওয়েট’ নেই। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন ছাড়াও প্রার্থী রয়েছে ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট, জাসদ, সুপ্রিম পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, এনপিপি ও গণফোরামের। চট্টগ্রামের ১৪টি আসনে প্রার্থী দিলেও ‘অর্থনীতির হৃদপিণ্ড’ হিসেবে পরিচিত এ আসনে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি জাতীয় পার্টি। ভোটে নেই বিএনপিও।

জানতে চাইলে এমপি লতিফ দাবি করেছেন, ‘এ পোস্টার প্রচার করা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে।’ অন্যদিকে, স্থানীয় ‘মুরব্বিরা’ ওই পোস্টারের ভাষাও নাকি বুঝতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সুমন।

পোস্টারটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে। কেউ কেউ তার পোস্টারের প্রশংসা করছেন, আবার নেতিবাচক মন্তব্যও করছেন অনেকে।

স্থানীয় জোবায়ের বাশার নামে এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘যেখানে বিএনপি-জামায়াতের লোক এ ধরনের কথা বলছে এবং সারাদেশে তারা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ ভোটচোর, সেখানে তিনবারের নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি বলছেন, ‘ভোটচোর ধরিয়ে দিন। এ ধরনের বিতর্কিত বার্তা প্রচারণার কোনো মানে হয় না। বিএনপি-জামায়াতকে টর্গেট করা অযৌক্তিক, কারণ তারা নির্বাচনে আসেনি। তারা আগুনসন্ত্রাস নিয়ে ব্যস্ত।’

চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ ইমন (ইমু) বলেন, ‘এই ধরনের বার্তা দেওয়ায় সকলের মনে প্রশ্ন জেগেছে, আসলে ভোট চোর কে? এমন বার্তা প্রচার করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পায়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এস এম বোরহান উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি এমপি লতিফের এই পোস্টারটির ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘‘চট্টগ্রাম-১১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী এম আবদুল লতিফ। দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর একই আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়ন নিয়েছেন ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। এখন প্রশ্ন হলো, ওই পোস্টারের ‘ভোটচোর’ কে?’’

তবে অনেকে মনে করেন এমপি লতিফ তার নির্বাচনী প্রচারণায় বরাবরই ভিন্নতা রাখেন। এ পোস্টারের পক্ষে ফেসবুকে লিখেছেন মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ খান নামে গোসাইলডাঙার একজন বাসিন্দা। তিনি লিখেছেন, ‘তিনি (এমপি লতিফ) আমার এলাকা আমার গ্রাম গোসাইলডাঙ্গার সন্তান। প্রথমবার তিনি যখন এমপি হয়েছিলেন আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। একদিন রাস্তায় ওনার নামে পোস্টার দেখি যেখানে লেখা ‘মক্ত খাই য’। অর্থাৎ, ফ্রিতে খেয়ে যাও। সম্ভবত পহেলা বৈশাখ কিংবা অন্য কোনো উপলক্ষে মেজবান দিয়েছিলেন তিনি। সেদিন পোস্টারে এমন উপহাস দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম। আর আজ যেই পোস্টার দেখলাম, ওনার ভাষা ও প্রচারণার প্রশংসা করতেই হয়।’

হঠাৎ কাকে উদ্দেশ করে এমন পোস্টার ?-এ প্রশ্নের উত্তর জানতে যোগাযোগ করা হয় এমপি লতিফের সঙ্গে। এ সময় প্রতিবেদককে তিনি উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘‘আপনি পড়েছেন, আপনি বুঝতে পারছেন না?’

লতিফ বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে নাকি নিচ্ছে না, সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। বাংলাদেশে ভোটচুরি শিখিয়েছেন জিয়াউর রহমান। এরশাদও ভোটচুরি করেছেন। বিএনপি আমাদের ভোটচোর ডাকলে আমরা কি বসে থাকব? ‘ভোটচোর’ কি আমি আমার পার্টিকে বলব নাকি? আমরা যে ভোটচোর না, সেটা আমরা সাহস করে বলতে পারি। চোর যখন দৌঁড়ায়, সামনের দিকে দেখিয়ে ‘চোর চোর’বলে দৌঁড়ায়। তখন মানুষ কনফিউশনে পড়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত হচ্ছে এ রকমের ভোটচোর।’’

এমপি লতিফের দাবি, বিএনপি এলেই কেবল হাড্ডাহাড্ডি লড়াইটা হতো। এখন প্রতিযোগিতা হবে, তবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই নয়।

ফেসবুকে তার পোস্টার নিয়ে আলোচনা সমালোচনার বিষয়টি উত্থাপন করলে এমপি লতিফ বলেন, ‘ফেসবুক একটা এমন জিনিস, আপনার যা খুশি, ফ্রি স্টাইলে বলতে পারেন। আমার নির্বাচনী এলাকায় আনুমানিক ২৫ লাখ মানুষ আছে। ফেসবুক নিয়ে বসে থাকে কত শতাংশ মানুষ? যারা ভোটার এদের মধ্যে বেশিরভাগ কাজকর্ম করে খায়। যারা ফেসবুকে নিজেদের ‘পপুলার’মনে করে তারা মাঠে গেলে বুঝবে! টিভিতে দেখিয়ে যারা মনে করেন, যত মানুষ দেখবে, ভোট বেড়ে যাবে। মানুষ আসলে কাজ দেখবে।’

‘নেগেটিভ কথা যারা বলে ওদের দিয়ে পজেটিভ কাজ হয় না। সবকিছুকে পজেটিভলি দেখলে ভালো করা যায়। নেতিবাচক মানুষদের আল্লাহ পছন্দ করেন না, দুনিয়ার মানুষও পছন্দ করে না। সমালোচক সমালোচনাতেই থেকে যাবে। আর ভাল কাজ করাবে আল্লাহ পজিটিভ মানুষদের দিয়ে।’—যোগ করেন লতিফ।

‘যাই হোক, এখন কথা হইল, যে, হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতেও অন্ধ। তারপর বাড়ির পাশে আরশি নগর সেথায় পরশি বসত করে। তারে চিনলাম না রে, তারে চিনলাম না রে’— এমন আওড়ে কিছুটা উদাসও হয়ে পড়েন এমপি লতিফ।

পতেঙ্গাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একটি সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা। এ ব্যাপারে অগ্রগতি কী? এ প্রশ্নের উত্তরে কাউন্সিলর সুমনকে একহাত নিয়ে এমপি লতিফ বলেন, ‘যারা হাসপাতালের কথা বলছে আপনাকে, তাদের জিজ্ঞেস করেন, একটা হাসপাতাল কিন্তু উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে, সেটি পতেঙ্গায়। আপনাকে কে বলছে আমি জানি না, ওই আহম্মককে বলেন; ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর (জিয়াউল হক সুমন) বলছে মনে হয়! তাকে বলেন, ‘আপনি কিসের কাউন্সিলর? আপনার ওয়ার্ডের মধ্যেই তো ওই হাসপাতাল।’

এমপি লতিফ আরও বলেন, ‘আপনি র‌্যাব গলির ভেতরে গিয়ে দেখবেন সাড়ে ৫ একর জায়গার ওপরে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ তলা দুটি বিল্ডিং। ওখানে ইতোমধ্যে সব ইকুইপমেন্ট নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।’

এমপি লতিফের পোস্টারটি কীভাবে দেখছেন? এ প্রশ্নে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন বলেন, ‘পোস্টারটি আমি দেখেছি। তিনি কি বুঝিয়েছেন সেটা আসলে আমার নলেজে নেই। তিনি তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। বয়সেও অনেক বড়। তাঁর বুদ্ধিও বেশি। এখন তিনিই বুঝবেন তাঁর ভাষা। আমরা আসলে তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতি করে এতটুকু উঠে এসেছি, আমি বুঝতেছি না। স্থানীয় মুরব্বিরাও ওই পোস্টারের ভাষা বুঝতে পারছেন না।’ -সিভয়েস