পবিত্র কোরআনে আল্লাহ নিজেই স্বীয় রাসূলের প্রশংসায় বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (ক্বলম ৬৮/৪)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন, بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاَقِ ‘আমি প্রেরিত হয়েছি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য’।
(হাকেম হা/৪২২১; ছহীহাহ হা/৪৫, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ))।
নবী সা: এর চরিত্র দেখে হযরত আমর ইবনে আস্বামা রা: ও হযরত ওনায়স গিফারী রা: ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি হাসিমুখে বিশুদ্ধ, মার্জিত ও সুন্দরভাবে কথা বলতেন। যা দ্রুত শ্রোতাকে আকৃষ্ট করত। আর একেই লোকেরা ‘জাদু’ বলত। তাঁর উন্নত ও শুদ্ধভাষিতায় মুগ্ধ হয়েই ইয়ামনের যেমাদ আযদী মুসলমান হয়ে যান।
(মুসলিম হা/৮৬৮ (৪৬); মিশকাত হা/৫৮৬০।)
সাহাবি রুশদ ইবনে আবদুর রহমান বলেন, ‘ইসলাম গ্রহণের আগে আমি রাসুল (সা.)-এর মেহমান হয়েছিলাম। তিনি আমার খোঁজখবর নিলেন। তাঁর কাছে আমাকে বসালেন। যতক্ষণ আমি তাঁর কাছে ছিলাম ততক্ষণ তাঁর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। তাঁর এই অসাধারণ আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম।’ (হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা : ৪৪৭)
আরবের মুহারিব গোত্র খুবই উগ্র ছিল। কট্টর ইসলামবিরোধী ছিল। ইসলামের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে যখন মানুষ দলে দলে মদিনায় আসতে লাগল তখন মুহারিব গোত্রেরও ১০ জন লোক মদিনায় এলো। রাসুল (সা.) তাদের অভ্যর্থনা-আপ্যায়নের জন্য বেলাল (রা.)-কে দায়িত্ব দেন। সকাল-বিকেল তাদের আহারের সুব্যবস্থা করেন। এতে তারা মুগ্ধ-বিস্মিত হলো এবং ইসলাম গ্রহণ করে নিজ দেশে ফিরে গেল। (আসাহহুস সিয়ার, পৃষ্ঠা : ৪৪৪)
নিজের ইহূদী কাজের ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার বাড়ীতে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেন ও পরিচর্যা করেন। এ সময় তিনি বলেন, তুমি ইসলাম কবুল কর। তখন ছেলেটি তার বাপের দিকে তাকাল যে তার নিকটে বসা ছিল। বাপ তাকে বলল, أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ ‘তুমি আবুল ক্বাসেম-এর কথা মেনে নাও। তখন ছেলেটি কালেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম কবুল করল। অতঃপর মারা গেল। এরপর রাসূল (ছাঃ) বের হবার সময় বললেন الْحَمْدُ للهِ الَّذِى أَنْقَذَهُ بِىْ مِنَ النَّارِ ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি তাকে আমার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন’।
(আবুদাঊদ হা/৩০৯৫; বুখারী হা/১৩৫৬; মিশকাত হা/১৫৭৪ ‘জানায়েয’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ)।
মক্কা বিজয়ের কয়েকদিন পর এক বৃদ্ধা তার সামান্য মালামাল পুঁটলি বেঁধে মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বয়সের কারণে পুঁটলি বহন করা তার পক্ষে কষ্ট হচ্ছিল। নবী করিম (সা.) এসে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, মা তুমি কোথায় যাচ্ছ? বৃদ্ধা বলল, অমুক যায়গায় আমার আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছি। কেন যাচ্ছ এ প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা বলল, শুনেছি মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদার ধর্মের বিরুদ্ধে এক নতুন ধর্ম প্রচার করছে। তাই জীবন রক্ষার জন্য মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) এবার বৃদ্ধার বোঝাটি নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বললেন, মা তুমি আমার সঙ্গে চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। বৃদ্ধাকে তার আত্মীয়ের বাড়ি দিয়ে নবী করিম (সা.) বললেন, তুমি এখানে থাক আমি যাচ্ছি। বৃদ্ধা বলল, বাবা তুমি কে? আমার জন্য এত কষ্ট করেছ? দ্বীনের নবী বললেন, আমার নাম মুহাম্মদ। আপনি যার কথা শুনেছেন আমিই সেই মুহাম্মদ। আমিই ইসলামের কথা বলে থাকি এবং এক আল্লাহর ইবাদতের কথা প্রচার করে থাকি। বৃদ্ধা বলল, যদি এটাই হয় ইসলাম তা হলে আমি গ্রহণ করতে রাজি। এ বলে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কালেমা পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই অসংখ্য লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কবি হাসসান বিন সাবিত (রা.) কাফেরদের প্রস্তাব অনুযায়ী অঢেল উপঢৌকনের আশায় গিয়েছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতে। উদ্দেশ্য ছিল নবীজির দোষ কবিতার মাধ্যমে বর্ণনা করা। যখন হাসসান বিন সাবিত নবীজিকে দেখলেন তখন তিনি বলেন : ‘যখন আমি তাঁর সৌন্দর্যের অপূর্ব জ্যোতির বিচ্ছুরণ দেখতে পেলাম, তখন দৃষ্টিশক্তি বিলুপ্ত হবে এ শঙ্কায় হাত দিয়ে চোখ দুটি চেপে ধরলাম। ফলে তার অপরূপ সৌন্দর্য যতটুকু দেখার ভাগ্যলিপি ছিল ততটুকু দেখতে পেলাম। এ যে আলোর আত্মা চাঁদের দেহে! এ যেন গহনা, যা বানানো আলোময় উজ্জ্বল তারা দিয়ে।’ এরপর তিনি কাফেরদের কাছে এসে বললেন, তোমাদের সম্পদ তোমরা নিয়ে যাও। এটা কোনো মিথ্যুকের চেহরা হতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ এক এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিঃসন্দেহে তাঁর প্রেরিত রাসুল।
এক বুড়ি মহিলা না বুঝেই ইসলামের বিরোধিতা করত এবং নবী করিম (সা.) কে কষ্ট দেয়ার জন্য মসজিদে যাতায়াতের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। একদিন পথে কাঁটা না দেখে তার কোনো অসুখ হল কিনা এই ভেবে দয়ার নবী বুড়ির খোঁজে তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছেন। গিয়ে দেখেন বুড়ি অসুস্থতার কারণে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। তিনি তখন ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়ে তার সেবা করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিচয় পেয়ে বুড়ি হতবাক হলে গেল। তার অমায়িক ব্যবহার দেখে বুড়ি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেল।
শুধুমাত্র পবিত্র কোরআন শ্রবণ করেই হযরত ওমর রা:, হাবশার বাদশাহ নাজাসী রা:, হযরত তোফায়েল ইবনে আমর দাওসী রা: ও হযরত যোবায়ের ইবনে মোতয়েম রা: ইসলাম গ্রহণ করলেন।
একদিন রাসুল (সা.) কিছু সাহাবির সঙ্গে তায়েফের পথে উকাজ বাজারে যান। নাখলা নামে একটি স্থানে তিনি ফজর নামাজ আদায় করছিলেন। জিনদের সেই দলটি তখন সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল। কোরআন শুনে তারা বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারল। তাদের অন্তর নরম হয়ে গেল। কোরআনের সত্যতার সামনে তারা মাথা ঝুঁকিয়ে দিল। (আয়াত: ১-২)
হযরত দ্বাম্মাত ইবনে সালাবা তাবাজুদী রা: শুধুমাত্র কালেমা তাইয়েবা শ্রবণ করেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা: ছিলেন ইহুদীদের মধ্যে সবথেকে বড় আলেম, তিনি নবী করীম এর পবিত্র চেহারা মোবারক দেখেই চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, ‘মহান আল্লাহর কসম! এমন সুন্দর জান্নাতি চেহারা কোনো মিথ্যাবাদীর হতে পারে না।’ শুধুমাত্র নবীর চেহারা দেখেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
 হযরত দ্বাম্মাত ইবনে সালাবা রা: ছিলেন তার গোত্র বনী সায়াদের নেতা ।তিনি একদিন আনমনে নবী করীম الله قل এর কাছে উপস্থিত হয়ে কসম দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি প্রকৃত পক্ষেই আল্লাহর রসূল?’
নবী করীম জবাব দিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি সত্যই আল্লাহর রসূল’।
তিনি আর কোনো প্রশ্ন না করেই ইসলাম গ্রহণ করলেন।
মদীনার বিখ্যাত দুই গোত্র আউস এবং খাজরাজ, তারা তাদের প্রতিবেশী ইহুদীদের কাছে শুনেছিলেন, শেষ নবী বর্তমান সময়েই আগমন করবেন। আর তিনি মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করবেন।
এ কথা তারা বিশ্বাস করে মক্কায় নবী করীম সা: এর মুখের কথা শুনেই বুঝলেন, এই ব্যক্তিই শেষ নবী। তারা কালবিলম্ব না করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তারপর মক্কা বিজয়ের পরে মক্কার বিভিন্ন গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তাদের দীর্ঘ দিনের লালিত বিশ্বাসের কারণেই। তাদের বিশ্বাস ছিলো, কা’বাঘর কোনো মিথ্যাবাদী কখনই নিয়ন্ত্রণ করবে না।
মক্কায় নবী করীম এর অসংখ্য মোজেযা প্রকাশ পেয়েছে। আবু জেহেল অনেক মোজেযা দেখেছে, কিন্তু তার হৃদয় সত্য গ্রহণের জন্য মুক্ত ছিলো না। সত্য সে গ্রহণ করতে পারেনি। আবু সুফিয়ান চন্দ্র দ্বিখন্ডিত ও বিভিন্ন ধরণের মোজেযা দেখলো, কয়েকটি যুদ্ধে মুসলমানদের অলৌকিক বিজয় দেখলো, তার মেয়ের সাথে রসূলের বিয়ে হলো, মেয়ের ভেতরে বিরাট পরিবর্তন দেখলো, কিন্তু তার অন্তরে কিছুই রেখাপাত করলো না। সে যখন নিজের চোখে দেখলো এবং নিজের কানে শুনলো, রোম সম্রাট নবীর পা ধুঁয়ে দিতে আগ্রহী, তখন তার চিন্তার জগতে বিপ্লব সাধিত হলো।
খৃস্টানদের নেতা আদী ইবনে হাতেম রা: নবীর দরবারে জাঁকজমকের সাথে আগমন করেছিলেন। তার ধারণা ছিলো, তার দেখা রাজা বাদশাহর মতই তিনি আচরণ করেন, কিন্তু তিনি যখন দেখলেন, সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকজন এলেও তার সাথে তিনি পরম আপনজনের মতই ব্যবহার করেন। তখন তার অন্তর বলে উঠলো, এই ব্যক্তি অবশ্যই আল্লাহর নবী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। অনেক ইহুদী- যারা জানতো শেষ নবী কেমন হবেন। তারা নবীর কাছে এসে তাঁকে দেখেই চিনেছেন, কথা বলেছেন এবং প্রশ্নের পরে প্রশ্ন করে সন্তোষজনক উত্তর লাভ করে ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
কেউ নবীর কাছে এসে দাবি করেছেন, ‘ঐ খেজুরগুলো যদি এসে আপনার নবী হওয়া সম্পর্কে সাক্ষী দেয় তাহলে আমি মুসলমান হবো।’
নবী করীম মহান আল্লাহর পবিত্র নাম উচ্চারণ করে ইশারা করেছেন, খেজুর কাছে এসে সাক্ষী দিয়েছে, এই মোজেযা দেখেই সে ইসলাম গ্রহণ করেছে।
(তিরমিজি)
কেউ দাবি করেছে, ঐ গাছটি যদি কালেমা পাঠ করে তাহলে আমিও কালেমা পাঠ করে ইসলাম কবুল করবো। রসূল ﷺ এর কথায় গাছ কালেমা পাঠ করেছে, সে এই অলৌকিক ঘটনা দেখে ইসলাম কবুল করেছে। এ ধরণের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে।
মহান আল্লাহ  নবী সা: এর চরিত্র সম্পর্কে বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ‘আর আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমলহৃদয় হয়েছ। যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হ’তে, তাহ’লে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। রাসূল (ছাঃ)-এর এই অনন্য চরিত্র মাধুর্য ছিল নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিশেষ দান।

লেখক: আমিনুর রহমান