হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর :

আহলান-সাহলান মাহে রামাযান। বছর ঘুরে আবারও মুসলিম উম্মাহর দ্বারে হাজির হলো পবিত্র রামাযান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। সর্বত্র সৃষ্টি হয়েছে ইবাদত-বন্দেগীর আবহ্।

মানব জাতিসহ সমগ্র সৃষ্টিকূলের জন্য কল্যাণময়ী ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম ইসলাম। মানবকুল ও সৃষ্টি জগতের অভূতপূর্ব কল্যাণ সাধনই হল ইসলামের প্রধানতম উদ্দেশ্য। এ মহান উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য মানব সমাজে সংযম ও আত্মশুদ্ধির অনুশীলন অপরিহার্য। যাতে করে মানুষ লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, অনাচার-অত্যাচার পরিত্যাগ করে সত্য ও সুন্দরের পথে ধাবিত হতে পারে। এই লক্ষ্যে প্রতি বছর ত্যাগ-তিতিক্ষা, আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের আহ্বান নিয়ে বিশ্ব মানবের দ্বারে হাজির হয় মাহে রামাযানুল মুবারক। রাহমাত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত সহকারে তাকওয়া ও মানব কল্যাণের আবেদন নিয়ে মাহে রামাযানের আগমনে শান্তিময় হয়ে উঠে সমগ্র পৃথিবী। কারণ এ মাস অন্য সব মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের বৈশিষ্টমন্ডিত। হযরত মুহাম্মদ সা. এর ওপর এ মাসেই আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেছেন সর্বশেষ ও সর্বোৎকৃষ্ট খোদায়ী মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, রামাযানে এমন একটি রজনী বিদ্যমান যা সহস্র মাসের চেয়েও উত্তম। ( সূরাতুল কদর, আয়াত- ৩)।

হাদীসের বর্ণনানুযায়ী আল্লাহর কাছে এ মাসের একটি ফরয ইবাদাত অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরয ইবাদাতের সমতূল্য এবং একটি নফল ইবাদত একটি ফরয ইবাদতের সমান। মুবারক এই মাসের প্রথমাংশে আল্লাহ্ তা’আলা মু’মিন রোযাদারগণের ওপর রহমত বর্ষণ, মধ্যাংশে তাদের পাপমোচন ও শেষাংশে জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান করেন। রামাযানুল মোবারকের অপরাপর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট ও বিধান হল মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা। মুসলমানদের জন্য এ মাসটি সংযম সাধনা, ধৈর্য ও সহানুভূতির মধ্য দিয়ে অগণিত পূণ্য ও সৌভাগ্য লাভের এক বসন্তকাল। রামাযানুল মোবারকেরই এক মর্যাদাপূর্ণ রাতে মক্কা নগরীর হেরা গুহায় শ্রেষ্ঠতম ও শেষনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা স. এর উপর পবিত্র কুরআন নাজিলের সূচনা হয়। রামাযানুল মোবারকেই ইসলামের ১ম ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী জিহাদ “বদর যুদ্ধ” সংঘটিত হয়েছিল। পবিত্র হাদীসের ভাষ্যমতে, এমাসে বেহেস্তের দরজা খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শিকলাবদ্ধ করে রাখা হয়। এছাড়াও পবিত্র এই মাসের প্রতিটি মুহুর্তে আরো অসংখ্য রহমত ও বরকত নিহিত রয়েছে।

রামাযান শব্দটি ‘রামাযুন’ শব্দ থেকে উদ্গত। এর শাব্দিক অর্থ জ্বালানো, দহন করা ভস্মীভূত করা। ‘রামাযান’ শব্দে ‘নুন’ অক্ষরটি মুবালাগা বা অতিশায়ন অর্থে ব্যবহৃত। সুতরাং রামাযানের অর্থ দাড়ায় এমনভাবে ভষ্মীভূত করা যাতে কিছুই অবশিষ্ট না থাকে। রামাযানের সিয়াম সাধনা যেহেতু কু-প্রবৃত্তি, কু-অভ্যাস ও পাপ রাশিকে পুড়িয়ে মানুষকে খাঁটি ও নিষ্কলুষ করে তোলে, সেহেতু এ মাসকে রামাযানুল মুবারক হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। ‘রোযা’ শব্দটি ফার্সি শব্দ রোয (দিবস) থেকে উদ্গত। যেহেতু এই সাধনা পূর্ণ দিবস ব্যাপৃত সে কারণে ফার্সীতে রোযা বলে। ‘সাওম’ শব্দের বহুবচন হচ্ছে সিয়াম অর্থাৎ বিরত থাকা। রামাযানের কাঠোর সিয়াম সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা যেহেতু মানুষকে সর্বপ্রকার অনৈতিক ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রেখে সংযম ও শৃঙ্খলার মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয় সেহেতু রোযাকে সাওম বা সিয়াম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তবে রোযা বা সিয়াম সাধনা সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার বন্ধ রেখে উপবাস থাকা নয় বরং দেহ ও মনকে সংযমে রেখে শরীয়ত নির্ধারিত জীবন বিধানের পরিপন্থী অসামাজিক কর্ম পরিহার করে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাকওয়া অর্জনের সাধনাই মাহে রামাযানের মূল দাবি।

নিছক রুটিন মাফিক উপবাস থেকে ইফতারী আর সাহরী খাওয়া ও তারাবীহ পড়াই রোযা বা সিয়াম সাধনার শেষ কথা নয়। এগুলি শুধুমাত্র রোযার কাঠামোগত দিক। এসব কর্মতৎপরতার সাথে সাথে সকল অবৈধ কাজ কর্ম পরিত্যাগ ও দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে শরীয়তের বিধান মতে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এভাবে সংযম ও আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ নিয়ে বাকি ১১ মাসে তা বাস্তবায়ন করতে পারলেই মানুষের ইহকাল ও পরকাল হবে সুখময় ও শান্তিপূর্ণ। নচেৎ এই রোযা হবে ধর্মের নামে একটি নিয়মিত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এর দ্বারা বিশ্বব্যাপী প্রবাহমান অনৈতিকতার প্রবল জোয়ার প্রতিরোধে কোন অর্জন সাধিত হবে না।

অতএব, আসুন! পবিত্র রামাযানে সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে যাবতীয় মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধন এবং মানব সমাজের সার্বিক কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার শপথ নিই। অধিক ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে এই মুবারক মাসের সদ্ব্যবহার করে আল্লাহ প্রদত্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাযাতের মত অপূর্ব নিয়ামতের অংশীদার হই।

লেখক : খতীব ,শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ, কক্সবাজার।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ।