সিবিএন ডেস্ক:
জামায়াত-শিবিরের ‘দুর্গ’ খ্যাত চট্টগ্রাম-১৫ সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন। সবার ধারণা ছিল, কেন্দ্রীয় নেতাদের ‘হস্তক্ষেপে’ হয়তো দলীয় মনোনয়ন যাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেবের হাতে। তবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখেও নৌকার বৈঠা পেয়ে যান এই আসনের দুবারের সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী। নৌকার বৈঠা হাতে পেলেও ‘নির্বাচনী স্রোত’ সামাল দেয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিনদিন। কেননা নদভীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেব। দুই উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের অধিকাংশ নেতাকর্মী জোট বেঁধেছেন মোতালেবের পক্ষে। তার ওপর রয়েছে কেন্দ্রীয় এক নেতার ‘আশীর্বাদের হাত’। ঈগল প্রতীকে ভোট চেয়ে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তারা।
অন্যদিকে এমপি নদভীর কাছ থেকে ‘সুবিধা’ আদায় করা নেতাকর্মীরাও ছুঁট দিচ্ছেন এই দুঃসময়ে। তবে দলীয়ভাবে কিছুটা ‘কোণঠাসা’ হলেও নৌকা নিয়ে প্রচারণার মাঠ আঁকড়ে আছেন ড. আবু রেজা নেজামুদ্দীন মুহম্মদ নদভী ও তাঁর স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরী। সঙ্গে রয়েছেন জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী।
ভোটের মাঠে একদিকে দলীয় নেতাকর্মীদের মুখে মুখে মোতালেবের জয়জয়কার, অন্যদিকে ভোটারদের মুখে ‘খেলায়’ কে জিতছেন নদভী নাকি মোতালেব। যদিও ঈগলের প্রচার-প্রচারণা, ভোটের মাঠে ‘পাক্কা’ নেতাদের খেল, মোতালেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভোটব্যাংক হিসেব করে মোতালেবের জয় নিশ্চিত দেখছেন অনেক ভোটার। কেউ কেউ বলছেন, ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’— ১০ বছরে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, দান ‘বরকত’ দেবে ভোটে। জামায়াত নেতার কন্যার রাজনৈতিক কৌশলেও ‘ধরাশায়ী’ হবেন মোতালেব পন্থীরা— এমন ধারণা কারও কারও।
‘বেগমসাহেবা’ বনাম ‘ডাক্তারের’ ভোটখেলা
ডা. আ.ম.ম মিনহাজুর রহমান। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের বহরে। নিজস্ব বলয়ের নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক কৌশলের কারণে এলাকায় স্থানীয় রাজনীতিতে বিস্তর প্রভাব তাঁর। দলীয় ভাটার টানেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নদভীর নৌকা পার করেছেন তিনি। নির্বাচনের পরে কিছুদিন নদভীর সঙ্গে ‘হৃদ্যতা’ থাকলেও ‘অজ্ঞাত’ কারণে দূরত্ব তৈরি হয় ‘ডাক্তার সাহেব’ নামে খ্যাত এই আওয়ামী লীগ নেতার। দূরত্ব ঘুচিয়ে ফের একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী বহর টেনে নেয়া হয় তাঁর মাধ্যমে। এই যাত্রায়ও সম্পর্ক টিকেনি বছর দেড়েকের বেশি। রাজনীতির মাঠে চাউর আছে, মূলত এমপি নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজার সঙ্গে ‘বনিবনা’ না হওয়ার কারণেই নাকি সম্পর্ক বেশিদিন টিকেনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ‘নিজের বলয়’ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ডা. মিনহাজের ওপর ‘ভর’ করেছে মোতালেবের নির্বাচনীযাত্রা। এম এ মোতালেবের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন এই ‘ডামি’ প্রার্থী। ভোটের মাঠে এমপিপত্নীকে ‘বেগমসাহেবা’ সম্বোধন করে তিনিই এমপি ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেব।
অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী ড. আবু রেজা নদভীর নির্বাচনী ভার তাঁর স্ত্রীর কাঁধে। প্রধান সমন্বয়ক হয়ে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন রিজিয়া রেজা। প্রচারণায় বেরিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেব, ডা. আ ম ম মিনহাজকে উদ্দেশ্য করে তীর্যকবান ছুঁড়ছেন তিনি। এমনকি ডা. মিনহাজকে গডফাদার আখ্যা দিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষ থেকে।
ঈগলের ‘খাঁচায়’ দুই উপজেলার নেতারা, শেষ মুহূর্তে নদভীকে ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকে
স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন দুই উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক দুজনই স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের পক্ষে। তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্য নাজমুল হাসান মিন্টু, মুজিবুর রহমান মুজিব, সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য আনোয়ার কামাল , সাধারণ সম্পাদক এরশাদুর রহমান রিয়াদসহ অধিকাংশ নেতা কাজ করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে।
সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছাড়া অধিকাংশ শীর্ষ নেতা মোতালেবের কুঁটিরে। স্বাচিপ নেতা ডা. আ.ম.ম মিনহাজুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক, দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের সহকারী সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। এ উপজেলায় দুই কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে একজনের পুরো বলয় মোতালেবের জন্য মাঠে, অন্যজনের ‘নীরবতায়’ যার যার সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়েছেন নেতাকর্মীরা।
ইউপি চেয়ারম্যানদের মধ্যে আধুনগরের চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন, বড়হাতিয়ার বিজয় কুমার বড়ুয়া, পদুয়ার হারুনুর রশীদ ও চুনতির জয়নুল আবেদিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। সাতকানিয়ায় এমপি নদভীর ভাতিজা-শ্যালক ও নলুয়ার লিয়াকত আলী ছাড়া সব চেয়ারম্যান এম এ মোতালেবের জন্য ভোট খুঁজছেন।
অন্যদিকে শেষ সময়ে এসে এমপি নদভী পাল থেকে ছুঁট দিচ্ছেন অনেকে। লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল হান্না মোহাম্মদ ফারুক, ফজলে এলাহী আরজু শুরু থেকে এমপি নদভীর পক্ষে মাঠে ময়দানে ঘুরলেও এখন প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন মোতালেবের পক্ষে। সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়েজ আহমদ লিটন একসময়ে ‘এমপি ঘরনার’ হলেও নির্বাচনে অবস্থান নিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পক্ষে।
লোহাগাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুল নৌকা প্রতীকের পক্ষে শুরু থেকে মাঠে ছিলেন। অসুস্থতার কারণে গত কয়েকদিন ধরে তাকেও মাঠে দেখা যাচ্ছে না। লোহাগাড়ায় বাবুল চেয়ারম্যানের ভোট ব্যাংক রিজার্ভ। ওই ভোট ব্যাংক ভেঙ্গে এখন ঈগল প্রতীকের পক্ষে মাঠে। দীর্ঘদিন তিনি এমপি নদভীর সঙ্গে ছিলেন।
এ ছাড়া দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জহির উদ্দিন, প্রচার-প্রকাশনা সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী, সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাস্টার ফরিদুল আলমসহ বেশ কয়েকজন এমপি নদভীর হয়ে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
নদভীর ওপরে ‘ক্ষিপ্ত’ আওয়ামী নেতাকর্মীরা, আশার প্রদীপ মোতালেব
‘দুইবার নৌকার পক্ষে কাজ করে নৌকাকে জিতিয়েছি। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে নৌকার জন্য ভোট চেয়েছি। নদভীকে দুইবার এমপি করেছি। তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেনি। আমাদেরকে কোনোদিন চিনেন নাই। নদভীকে প্রথম লোহাগাড়ায় আনছি আমরা।’— এমপি নদভীর ওপর আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন লোহাগাড়া সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি মো. মোরশেদ।
তাঁর সঙ্গে সুর মেলালেন, স্থানীয় আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তিনি বললেন, আমি প্রথমে নৌকার পক্ষে ছিলাম। তাদের কাছে মূল্যায়ন না পেয়ে এখন ঈগলের সাথে কাজ করছি ঈগল মূল্যায়ন করছে। আমরা সবাই নৌকার পক্ষে ছিলাম। এখন আমরা নদভীর সাথে নেই।’
‘ঈগলের সমর্থক বেশি। ঈগল এগিয়ে থাকবে। ঈগলের সাথে আওয়ামী লীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক আছে। এমপি সাহেব তো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ঠিক রাখতে পারে নাই।’ কেন পারে নাই?— এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন এমপি সাহেব তো এখানে থাকেন না। উনি ঢাকায় থাকেন। উনার অন্যান্য কাজ আছে ওগুলো নিয়ে থাকেন। উনি ভুল মানুষকে দায়িত্ব দিছেন। উনার কাছে যেতে হলে হাইব্রিড নেতাদের ধরণা দিতে হয়। আমরা যারা পদপদবী ছাড়া দলকে ভালোবেসে রাজনীতি করি তাদের জন্য এগুলো অপমানজনক।’— নৌকার পক্ষে না গিয়ে কেন স্বতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান, এমন প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বলছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের সমর্থক মো. রাহাত হোসেন।
এবারের ভোটে এমপি নদভীর বিরোধীতা করার অন্যতম কারণ হিসেবে দলীয় লোকজনের সঙ্গে খারাপ আচরণ, অবমূল্যায়নকে দুষছেন এই আসনের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে ‘হাইব্রিড’ নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করার অভিযোগও তুলেছেন তারা। হাইব্রিডের পিষ্টে নাকি নেতাকর্মীরা এমপি নদভীর পাশও ঘেঁষতে পারতেন না। এঁওচিয়ায় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ‘চড়’ মারতে উদ্যত হওয়ার ভাইরাল ভিডিওটি নির্বাচনে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন মোতালেব অনুসারীরা। ‘
ক্ষিপ্ত’ নেতাকর্মীরা ভিড়েছেন মোতালেবের দলে। তাঁকে নিয়েই আশার প্রদীপ জ্বালাতে চান আওয়ামী নেতাকর্মীরা। তারা মনে করছেন, এম এ মোতালেব যেহেতু রাজনীতির মাঠের মানুষ, নেতাকর্মীদের চাওয়া-পাওয়া বুঝবেন। উনি তার মূল্যায়ন করবেন। তাদের ভাষ্য, নেতাকর্মীদের বড় কিছু চাওয়া থাকে না। এলাকার লোকজনের স্বার্থে উন্নয়নের আবদার থাকে। অভাব-অনটনে থাকা লোকজনের জন্য যাওয়া লাগে। গেলে একটু সম্মানজনক সমাদর করা এতটুকুই।
শহিদুল আলম নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, মোতালেব সাহেব দীর্ঘ দশ বছর যাবত একটি সংগঠনকে মূল্যায়ন করে আসছেন। উনি রোজার সময় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আমাদের ওয়ার্ড কমিটি সবাইকে ডেকে শাড়ি-লুঙ্গি দিয়েছেন, ইফতার দিয়েছেন। বন্যার সময় সব কিছু দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছেন। আমরা ভালো মানুষের পক্ষেই কাজ করছি। তিনি সবার খবরাখবর রাখছেন।
‘১০ বছরে এমপি সাহেবের সাথে আওয়ামী লীগের অরিজিনাল কোনো লোক ছিলো না। সব হাইব্রিড। উনি হাইব্রিড নিয়ে থাকার কারণে উনাকে আসল আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেছে। এখন যারা আছে সবাই এমপির সুবিধাভোগী।’
লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. খোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, নদভী সাহেব দুই বারে দশ বছর লোহাগাড়া সাতকানিয়াবাসীর উপর জোর জুলুম চালিয়েছে। মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। এলাকার উন্নয়ন করতে পারেনি। সরকারি বরাদ্দ লুটপাট করেছে। এতে দলের বদনাম হয়। আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি আমাদের বদনাম হয়। তাই আমরা চিন্তা করলাম একজন ভালো মানুষ যোগ্য মানুষকে মানবসেবা করার মতো মানুষকে আমরা বেছে নিয়েছি তিনি একজন জনবান্ধব মানুষ। নদভী সাহেব উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। জয়নুল আবেদিন সাহেব তাকে এনে এমপি করেছেন, তিনি ভেবেছিলেন মানুষের খেদমত করবে। আজকে তার জন্য আবেদীন সাহেবের কবর আজাব বেড়ে গেছে। তার কারণে আবেদীন সাহেবের দুর্নাম বেড়ে গেছে। আবেদিন সাহেব অনেক উন্নয়ন করেছেন তার সব ভেস্তে যাচ্ছে নদভীর জন্য।
প্রচারণায় ঈগলের জয়জয়কার, দিনরাত সমানে চলছে নৌকার প্রচারণা
আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. আবু রেজা নদভীর লোহাগাড়ার প্রধান নির্বাচনী ক্যাম্প সিটিজেন পার্ক। পুরো ক্যাম্প ঘুরে ‘কাকপক্ষীরও’ দেখা মিলেনি। অর্ধ শতাধিক পোস্টারও চোখে পড়েনি এই ক্যাম্পে। একই অবস্থা উপজেলার অন্যান্য নির্বাচনী ক্যাম্পেও।
সরেজমিনে সাতকানিয়া উপজেলার চরতী, ঢেমশা এবং পশ্চিম ঢেমশা, সাতকানিয়া সদর ইউনিয়ন এবং লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি, আধুনগর, চরম্বা, লোহাগাড়া, আমিরাবাদ, পদুয়া ইউনিয়ন ঘুরে মূল সড়কে পোস্টার কিছু পোস্টার সাঁটানো দেখা গেছে। তবে সেখানে ঈগলের পোস্টারেরই আধিক্য।
মোতালেবের জন্য দলীয় নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেও খুব একটা দেখা মিলছে না এমপি নদভীপন্থীদের। তবে নিজ অনুসারিদের নিয়ে দিনেরাতে সমানতালে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
‘মজা’ নিচ্ছেন ভোটাররা
‘মাকাল ফল দেখতে লাগে লাল, বাক্কুর গরি হর মাইরল্লে ভেয়াডাই গেইলগই গাল। অ-নে নয়? মাকাল ফলরে অনরা ভোট দিবান নে? মাকাল ফল দেহিয়েরে ফাল মারিবান নে।’, ‘নতুন চইল হচাল ন অইবো? নিচর দি ফুরা ন লাগিবো? বাশ ন উড়িবো? হাইত তারিবান নে?’— (মাকাল ফল দেখতে লাল লাগে, কামড় দিলে গাল নষ্ট হয়ে যায়, ঠিক কিনা? মাকাল ফলকে আপনারা ভোট দিবেন? নতুন চাল ঝরঝরে হবে? নিচে পোড়া যাবে না, গন্ধ উঠবে না, খেতে পারবেন) ভোটের মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবকে উদ্দেশ্য করে এমন রসালো বক্তব্য রেখেছেন এমপিপত্নী রিজিয়া রেজা চৌধুরী।
‘অওবা আরুগ্গা জিবা দেহাইয়ে চিল মার্হা চিল, চিল এ জেন্ডিলা কুরার ছ লই যা গয়। এন্ডিলা অনরার ভোট ওন লই ধাই যাইবোই। পাইবান নে ইবারে অনরা? ইবা আইয়ের দে ব্যবসা গরিবার লায়, আজার কোটি টিয়া হামাইবার লায়। কেন গরি হামাইবো দে? মইদ্দার ফুয়ারে ফঁচা ডিম ন মিয়াইবো, ছানার ফুঁয়ারে ছ্যাকারিন ন মিয়াইবো, বিস্কুটত হম ন দিবো, চনাচুরত হম ন দিবো? অনরারে ভেজাল বিয়াগ্গিন হাবাইবো।— মুচকি হেসে হেসে মোতালেব উদ্দেশ্য করে এমন বক্তব্যও রাখেন নারী সমাবেশে। এ সময় উপস্থিত নারীরাও মিটিমিটি হাসি শুরু করে।
অন্যদিকে এমপি নদভী ও তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আরো মজার মজার স্লোগান বক্তব্য দিচ্ছেন মোতালেব পন্থীরা। ‘বউত দিন হাইয়্যো আর ন হাইয়্যো, ভাইপ্যুত হাইয়্যে, ভাইজ্যি হাইয়্যো, য়ালা হাইয়্যে বউয়ে হাইয়্যে, আর ন হাইয়্যু,’ ‘বাজে না তো আর বাজে না, মনও আর সাজেনা’, ‘বাঁশিও বাজেনা মনও সাজেনা’, ‘ও আমার ভাবিজান, নাও বাওয়া মদ্দ লোকের কাম, জোয়ান পোলার কাম’— এমন রসের রসের স্লোগানে মোতালেবের প্রচারণা মাতিয়ে রাখছেন স্বাচিপ নেতা ডা. আ.ম.ম মিনহাজুর রহমান।
উত্তাপের সঙ্গে শঙ্কাও ভোটারদের মনে
এমপি নদভী-মোতালেবের ভোটখেলা ঘিরে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার নির্বাচনী মাঠ জমে উঠলেও শঙ্কা ভর করেছে ভোটারদের মনে। ভোটের দিন তাদের ‘খেলা’ কেমন হবে সেই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মাথায়।
উত্তর আমিরাবাদের বাসিন্দা বদিউল আলম। সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সী বদিউল আলমের কাছে এলাকায় ভোটের কি অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোটের কি অবস্থা এখনও বুঝতে পারছিনা বাপ। দুই জন শক্ত প্রার্থী। দুজনই সমানে সমান। এখনও বুঝা যাচ্ছেনা।’
এমন পরিস্থিতি সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় কখনো দেখেন নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতি দেখেছিলাম কখন মনে পড়েনা।। দুই প্রার্থী মাঠে শক্ত অবস্থানে। কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি নয়। ঈগল পাখির কথা মানুষ কয়। দেখি বাকিটা।’ বদিউল ইসলাম উত্তর আমিরাবাদ এম. বি. উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটার।
কেরানীহাট সিএনজি স্ট্যান্ডে পান-সিগারেটের দোকানি আফসার উদ্দিন। তাঁর আতঙ্ক ভোটের দিন নিয়ে। তার ভাষ্য কেউ ভোট সেন্টারে যেতে বলে কেউ আবার যেতে নিষেধ করে। ‘শুনছি ভোট কেন্দ্রে মারামারি হবে ধরাধরি হবে। মানুষের মুখে মুখে এখন এসব শুনে চিন্তায় আছি যাবো কি যাবো না।’— বলেন আফসার উদ্দিন।
২০ বছর প্রবাস জীবনের প্রথম দেশে এসে নির্বাচন পেয়েছেন ওমান প্রবাসী মাহবুবুল ইসলাম। ভোটের ঠিক আগের দিনই ওমান ফিরে যাবেন। ভোট দিয়ে একদিন পর গেলেও তো পারতেন। এ কথা বলতেই তিনি মুখ খুললেন। বললেন, কি নির্বাচন ভাই? একপক্ষ নির্বাচন করছে। নৌকা স্বতন্ত্র একই দলের। কোনো আমেজে আছে? আরেক পক্ষ তো মাঠেই নেই। এভাবে তো নির্বাচন জমে না।
চুনতি থেকে কেরানিহাটগামী সিএনজি অটোরিকশার চালক মো. হোসাইনকে এবারের নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আগে নির্বাচন আসলে ঈদের চেয়ে বেশি খুশি থাকতাম। এখন আর ওইরকম আমেজ নাই, আনন্দ নাই। দেশের সব দল নির্বাচনে আসলে আমেজটা থাকতো। খেলাটা আরো জমতো।
লোহাগাড়া সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মো. মোরশেদের সাথে কথা হয় ৬ নম্বর লোহাগাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে। তিনি বলেন, লোহাগাড়ায় যদি সুষ্ঠু ভোট হয়। নির্বাচন কমিশন, লোহাগাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ওসি যদি ভোট দেয়ার পরিবেশ করে তাইলে ঈগল এক লক্ষ ভোটে হারাবে নৌকাকে। কারণ লোহাগাড়ার জনগণ ঈগলের কাজ করতেছে। অন্যায়ভাবে বা কোনো বিশৃঙ্খলা করে যদি বিজয় নৌকার পক্ষে দেয় কোনো সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী যদি অসৎ কাজ করে নৌকার পক্ষ নেয় আমরা মানববন্ধন করবো। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে । সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে।
‘স্ত্রী, ভাতিজা, শ্যালকের পাপে ডুবেছেন নদভী’
‘নদভী সাব ভালা মানুষ। সোজাসাপ্টা। যিয়ান হয় ইয়ান মুখর উয়দ্দি, ভিতরে কিছু নাই, এমপি অইবার আগেও নলকূপ, মসজিদ মাদ্রাসা গরি দিয়ে। যে গেইয়্যে তারে বুগত লইয়ে।’— বলছিলেন দেওদীঘি এলাকার এক ভোটার। এমপি ঘরনায় পরিচিত হওয়ায় নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি। এমপি নদভী সম্পর্কে তাঁর ২০ বছরের ধারণা পাল্টে গেছে গত ১০ বছরে। তাঁরও আক্ষেপ এমপি নদভীর পাশে আগের মতো ঘেঁষতে পারেন না তার অনুসারীদের জন্য। এজন্য তিনি দায়ী করছেন তাঁর স্ত্রী, শ্যালক, ভাতিজাকে। তারা নাকি তাদের দলভারী করতে ‘হাঁটঘাঁট’ থেকে মানুষ এনে যোগ্য লোকদের অসম্মানিত করে এমপির পাশ থেকে সরিয়েছেন। একইকথা ভেসে বেড়াচ্ছে দলীয় নেতাকর্মীদের মুখেও। প্রকাশ্যে এসে না বললেও তাদের আলাপ আলোচনায় উঠে আসছে এসব কথা। যদিও এমপি নদভীর বিরুদ্ধেও একাধিক অভিযোগ তুলেছে নেতাকর্মীরা।
ভোটের মাঠে হামলা-সংঘর্ষ
ভোটের মাঠে এরমধ্যে নদভী এবং মোতালেব সমর্থকরা বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। হামলা, ভাঙচুর ও গুলিবর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মুহম্মদ নিজাম উদ্দিন নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা নির্বাচনী প্রচারণাও হামলা চালানো হয়েছে সেখানে চরতী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরী, সাতকানিয়া থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান গুরুতর আহত হন।
অন্যদিকে পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিদুয়ানুল ইসলাম সুমনের বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর ও গুলিবর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনায় তিনি সরাসরি সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন নদভীর দিকে অভিযোগের তীর ছুড়েছেন। রিদুয়ানুল ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী মোতালেবের হয়ে কাজ করছেন। এসব ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছে।
‘জামায়াতী কৌশল’ এমপিপত্নীর, মোতালেবের পুঁজি ‘মুক্তি’
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন থেকে জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা শাহজাহান চৌধুরী ১৯৯১ ও ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হন একই দলের আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা শামসুল ইসলাম। আওয়ামী রাজনীতিতে চাউর আছে— ওই সময়ে লোকজনকে দাঁড়িপাল্লায় ভোট না দিলে জান্নাতে যাওয়া যাবেনা বুঝিয়ে সাধারণ ভোটারদের কাবু করতেন জামায়াত ইসলামীর কর্মীরা। ঠিক একই কৌশল অবলম্বন করেছেন জামায়াত নেতা মমিনুল হক চৌধুরীর কন্যা রিজিয়া রেজা চৌধুরী— এমন দাবি আওয়ামী নেতাকর্মীদের। ধর্মীয় বিষয়ে দেয়া তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোতালেব সমর্থিতরা।
ওই ভিডিওতে এমপিপত্নী রিজিয়া রেজা চৌধুরীকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে শোনা গেছে, আপনাদের ভোট নিয়ে এমপি সাহেব মসজিদ বানাবে না, এতিম খানা বানাবে না, গরীব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াবে না? ৫ বছর সওয়াবের কাজ করবে এগুলোর সওয়াব আপনারা পাবেন না? আপনাদের কিয়ামতের মাঠ পার হতে হবে না, পুলসিরাত পার হতে হবে না? হাশরের ময়দান পার হতে হবেনা? তাঁর এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে কৌশলে ‘ফায়দা’ নিচ্ছেন প্রতিপক্ষরা। এছাড়া নির্বাচনে ৭০ হাজার জ্বীন নামানোর, আধ্যাত্মিক শক্তি ব্যবহার করা হবে এমন বক্তব্যও নাকি এমপি নদভী রেখেছেন। অন্যদিকে ভোটের মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের প্রধান পুঁজি ‘নদভীর পরিবার থেকে’ সাতকানিয়ার মানুষকে মুক্তির ধ্বনি।
প্রার্থীরা যা বলছেন
নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার মানুষকে সেবা দিয়েছি। উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে এবারও নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আমাকে জয়যুক্ত করবে। ভোটের মাঠে আমি পাকাপোক্ত মানুষ। মানুষের ভালবাসা সমর্থন আগের চেয়ে দ্বিগুন বেড়েছে। এবারও ভোট যুদ্ধে নৌকা প্রতীক বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী এম.এ মোতালেব বলেন, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। জনগনই সকল উৎস। তাদেরকে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি। তারা ভোট দিতে পারলে ঈগল প্রতীক বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে। আমার প্রতিপক্ষ নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ড. নদভী সাহেব ভূলে গেছে হুমকি-ধমকির দেন শেষ। জনগনের ভালবাসা অর্জনই মুখ্য বিষয়। -সিভয়েস
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।