– মন্জুর সাদেক 

১। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে গহীন জঙ্গলের কাছাকাছি একটা হাসপাতাল আছে। মালুমঘাট খ্রিষ্টান মিশনারী হাসপাতাল। কক্সবাজার জেলার আশির দশকের আগে জন্ম নেওয়া প্রায় সব মানুষের এই হাসপাতালের কোন না কোন স্মৃতি আছে। সাধারণত হাসপাতালের স্মৃতি ভয়ের, আতংকের। এ মিশনারী হাসপাতালের সাথে স্মৃতি অনেকাংশে স্বস্তির। এ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ বিশ্বখ্যাত ডাক্তার ভিগো অলসেন দু’দিন আগে পরলোকে চলে গেছেন। কক্সবাজার জেলাবাসী হিসেবে তাঁর কিছু স্মৃতিচারণের দায় আমার আছে। তাই এ লেখার অবতারণা।
২। উনিশশত ষাটের দশকের কথা। ডাক্তার ভিগো অলসেন এর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সার্জারীর এমডি করেছেন। নামকরা সার্জন হিসেবে আমেরিকার নেব্রাস্কা এবং পাশের রাজ্যগুলোতে তাঁর খ্যাতি বেড়ে চলছে। অপারেশন টেবিলে মানব শরীর কাঁটাছেড়া করতে করতে ইদানীং প্রায় ভাবনায় পড়ে যাচ্ছেন। এত সুশৃঙ্খল মানবদেহ! যতই চিন্তা করেন, ততই অবাক হন। ছাত্রজীবনে পাড় নাস্তিক ছিলেন। তাঁর স্ত্রীও নাস্তিক। কিছুদিন হয়, তাঁর যুক্তি হিসাব সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তিনি চার্চে যাওয়া, বাইবেল পড়া শুরু করছেন। খ্রিষ্টান মিশনারীদের কাজও নিয়ে ভাবছেন। তাঁদের অনুদান দিচ্ছেন।
৩। একদিন চার্চের একটা বিজ্ঞাপন তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। পূর্ব পাকিস্তানের সাগর, পাহাড় ঘেরা উপকূলীয় একটি জেলা-কক্সবাজার। প্রায় ১.২ মিলিয়ন মানুষের বাস, অথচ তেমন কোন হাসপাতাল নেই। খ্রিষ্টান মিশন একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করছে- এর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একজন ডাক্তার প্রয়োজন। অলসেন, ভাবনায় পড়ে গেলেন। একদিকে আমেরিকান জীবন, ক্যারিয়ার, সাফল্য। অন্যদিকে, অজানা, অচেনা একটি দেশে ১.২ মিলিয়ন চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষ। তিনি ঈশ্বরের ইশারা বোঝার চেষ্টা করলেন। তাঁর মনে হলো, ঈশ্বর তাঁর জীবনের পথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি স্বস্ত্রীক কক্সবাজারের সেই পাহাড়ি হাসপাতালে চলে আসলেন।
৪। তারপর প্রায় তিরিশ বছরের বেশি এ হাসপাতালে কাটিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের রোগীরা তখনও মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী, ডারমাটোলজি, অর্থোপেডিকস, অনকোলজি ভাগ করতে শেখেনি। ডা. অলসেনও স্পেশালিটির দোহাই দিয়ে কাউকে কখনো ফিরিয়ে দেননি। সব রোগের ঔষধ দিয়েছেন, সব ধরণের অপারেশনও করেছেন। সাফল্যও আকাশচুম্বী। অথচ কি অনাড়ম্বর, কি বিনয়। কক্সবাজার বাসী কখনো জানতে পারেনি, আমেরিকার এক বিখ্যাত ডাক্তার তিরিশ বছর ধরে তাদের সেবা দিয়ে গেছেন।
৫। একাত্তর সালে ডা. অলসেন নির্যাতিত মানুষ, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাঁর হাসপাতাল সর্বদা খোলা রাখতেন। মার্কিন সরকার তাঁকে খবর পাঠালো- বাংলাদেশ তাঁর জন্য আর নিরাপদ নয়। তিনি যেন দ্রুত দেশে ফিরেন। তিনি নাফ নদী পার হয়ে রেঙ্গুন হয়ে আমেরিকা চলে গেলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরী করছে। বাংলাদেশের পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, আহত, বিধ্বস্ত হাজার হাজার মানুষের জন্য তাঁর মন কাঁদছে। তিনি বিশেষ চ্যানেলে ভিসা সংগ্রহ করে হাসপাতালে চলে আসলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে আসা তিনিই প্রথম আমেরিকান।
৬। ছিয়াত্তর সালের দিকে আমার হাতে পায়ে বিশ্রী খোস পাঁচড়া হলো। স্কুলে সহপাঠীরা কিভাবে জানি তাকায়। কক্সবাজার শহরে তখন তিনজন এমবিবিএস, কয়েকজন এলএমএফ। আমার রোগের সুরাহা হলোনা। বাবা তখন কক্সবাজার পিটিআই এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ডাক্তার অলসেন এর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো। বাবা একটা হাতচিঠি দিয়ে আমার এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে আমাকে পাঠালেন। তিনি তাঁর সহকারীকে ঔষধ বুঝিয়ে দিলেন। সহকারী আমাদের বুঝিয়ে বললেন, ঔষধ লাগানোর নিয়ম মানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঔষধ সারা শরীরে প্রতিদিন লাগাতে হবে, এক সপ্তাহ গোসল করা যাবেনা। চারদিনের দিন দেখা গেলো, খোস পাঁচড়া নির্মূল হয়ে গেছে।
৭। আশির দশকের মাঝামাঝি গ্রামের বাড়ি কুতুবদিয়া গেছি। আমাদের পাড়ায় আমাদের এক বর্গাচাষীর ভিটা বিরান হয়ে গেছে, তাঁকে নিয়ে কানাঘুঁষা। জানা গেলো, সে ডা. অলসেন এর পিয়নগিরি করে। মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান হয়ে গেছে। তাই, বাড়ি আসার সাহস নেই। জটিল এক পেটের ব্যথায় সে গড়াগড়ি দিতো। কোন মুসলমান পীর ফকির ডাক্তার তাঁকে সুস্থ করতে পারেনি। ডা. অলসেন অপারেশন করে তাঁকে সুস্থ করেছে। তাই, সে খ্রিষ্টান হয়ে বাকি জীবন তাঁর সাথে থেকে গেছে।
৮। ২০১৬ সালে আমার ফিলিপাইনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোরার সুযোগ হয়েছে। সবদিকে খ্রিষ্টান মিশনারীদের স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল। ফিলিপাইনে খ্রিষ্টান মিশন কাজ শুরু করেছে, প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে। হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা স্থানীয় ধর্মাবলম্বী একটি জাতির সিংহভাগ খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করার প্রধান কারণ যে এই মিশনারী কাজ, তা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। বাংলাদেশে মিশনারী কাজ শুরু হয়েছে, উইলিয়াম কেরীর হাতে ১৭৭৩ সালে। বাংলাদেশে মিশনারী হাসপাতালের চেয়ে স্কুল, কলেজ বেশি। বাংলাদেশে মিশনারী ডাক্তারদের মধ্যে ডা. অলসেনই সবচেয়ে বিখ্যাত মানবতাবাদী চিকিৎসক।
৯। অলসেনের লেখা বইয়ের সংখ্যা তিনটি। ডাক্তার -১, ডাক্তার -২ এবং ডাক্তার ডিপ্লোমেট ইন বাংলাদেশ। তাঁর বই সাধারণ বই নয়। মানবপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম, চিকিৎসা পেশার প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রতা, স্পিরিচুয়ালিটি আর মিশনারী কাজের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তাঁর বইগুলোকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে।
১০। ইসলাম ধর্মে মিশনারী কাজ, ধর্মপ্রচারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। মানুষের সেবা করে, আচরণ দিয়ে মানুষের মন জয় করার সুন্নাহ আমাদের নবীর সারা জীবনের কাজ। তাঁর এ কষ্টকর সুন্নাহ মুসলমানরা বেশি একটা নেয়নি। সহজ সুন্নাহ গুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পিত মুসলিম মিশনারী কাজের উদাহরণ বেশি একটা নেই। সাতক্ষীরা জেলার নলতা শরীফের পীর আহছানউল্লা স্কুল, কলেজ হাসপাতাল শুরু করেছিলেন। আহছানউল্লা ক্যান্সার হাসপাতাল, মিশন হাসপাতাল, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় একশ বছর আগে তাঁর সেই শুরু করা কাজের ধারাবাহিকতা। বায়তুশ শরফের পীরও হাসপাতাল করেছেন। তাঁদের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা। তবে, খ্রিষ্টান মিশনারিরা মানবসেবায় অনেক এগিয়ে। হোক না তাঁদের নিয়ত ধর্মপ্রচার, কিন্তু তাঁদের নিষ্ঠা, একাগ্রতা, মানবসেবায় আমি কোন খাদ দেখিনা। তাঁরা কাউকে জোর করে ধর্মান্তরিত করেনি। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে বলেনি, খ্রিষ্টান না হলে রোগীর অপারেশন হবেনা! ডা. অলসেন তাই আমার কাছে নিষ্ঠা, একাগ্রতা, মানবসেবায় এক সুপার হিউম্যানের নাম।
১১। অলসেন বেঁচেছেন প্রায় পঁচানব্বই বছর। আশির দশকের শেষদিকে বাংলাদেশ ছাড়ার পর ক্যালিফোর্নিয়ায় হাসপাতাল এবং মিশনারী কাজের সাথে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় বাইবেলের সহজ অনুবাদ তাঁর বিশেষ আগ্রহে তৈরি করা হয়েছে।
তাঁর স্মৃতির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা।

– ফেসবুক থেকে