চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে প্রায় ৯ বছর আগে বিলুপ্ত এক সমিতির নাম ব্যবহার করে পূনরায় রেজিস্ট্রেশন চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি ৪২ বছরের ঐতিহ্যবাহী মাঝিমাল্লার সংগঠনটিকে বিতর্কিত করতে অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে সুবিধাবাদি গ্রুপ এমনও কানাঘুষা চলছে।
ইতোমধ্যে এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে প্রকৃত সমিতির সদস্যরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাছে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন।
এতে অভিযোগ তোলা হয়েছে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের আবুল কালাম প্রকাশ কালা মিয়া ও ছালামত খাঁন নামে দুই ব্যক্তির উপর। যাদের যোগসাজেসে পরিত্যক্ত দোকানঘরকে সমিতির অফিস ও কিছু ভূয়া সদস্য দেখিয়ে নিবন্ধন নেওয়ার পাঁয়তারা করছে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ।
ফলে, সদরঘাট সাম্পান মালিক কল্যাণ সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ আলী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে অনুলিপি প্রেরণ করেছেন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী, সমাজ কল্যাণ সচিব, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক, কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সমাজসেবা অফিসার ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে।
ঘটনার অনুসন্ধানে জানা যায়, আজ থেকে দীর্ঘ ৪২ বছর আগে কর্ণফুলী এলাকার মাঝি মাল্লাদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় গড়ে ওঠে ‘সদরঘাট সাম্পান শ্রমিক কল্যাণ সমিতি’। যার রেজিষ্ট্রেশন নং-৮২৩/৮০। সমিতির তথ্যমতে ১৯৮০ সাল হতে এই সমিতির সদস্যরা সদরঘাট এলাকার নৌ-ঘাট থেকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড় (চরপাথরঘাটা) ব্রিজঘাটে যাত্রী পারাপার ও পণ্য পরিবহন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
এভাবে চলতে থাকে সমিতির কার্যক্রম। কয়েক বছর পর সমিতির সদস্যদের মাঝে নিষ্ক্রিয় ভাব উদয় হয়। অসাবধানবশত সমাজসেবা অধিদপ্তরের শর্তাবলী লঙ্ঘন ও বিধি বিধানের কারণে এক সময় সমিতি অচল হয়ে যায়। এরমধ্যে ২০১২ সালের ১৩ আগষ্ট সমাজসেবা অধিদপ্তর (নং-৪১.০১.০০০০.০৪৬.২৮.১৩১.১২-৪৮০) স্মারকের এক আদেশে ৮২৮টি সমিতি বিলুপ্তির তালিকা প্রকাশ করেন। মহাপরিচালক নাছিমা বেগম (এনডিসি) স্বাক্ষরিত ওই তালিকার ৩৪৯ নং ক্রমিকে ‘সদরঘাট সাম্পান শ্রমিক কল্যাণ সমিতি’র নাম চলে আসে। জানা যায়, নিয়মনীতি, সমিতির বিধি বিধান ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়মিত অডিট সম্পন্ন না করায় উল্লেখিত সমিতি বিলুপ্ত করা হয়।
সূত্র জানায়, পরবর্তীতে উক্ত সমিতির রেজিষ্ট্রেশন পূনরায় ফিরে পেতে সদস্যরা চেষ্টা চালায়। কিন্তু সমাজসেবা কার্যালয় বিলুপ্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানের পূর্বের রেজিষ্ট্রেশনসহ অনুমোদন কোন ভাবেই সম্ভব নয় বলে জানান। এমন অবস্থায় সমিতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা সমিতির নাম পরিবর্তন করে পূনরায় নতুন রেজিষ্ট্রেশন (নম্বর চট্ট-২৮৫৬/১৭) লাভ করে ‘সদরঘাট সাম্পান মালিক কল্যাণ সমিতির নতুন কার্যক্রম চালু রাখেন।
এরমধ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রকৃত সাম্পান মালিক, মাঝি কিংবা শ্রমিক না হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সুবিধা ও ফায়দা লুটাতে সমাজসেবা দপ্তরে পূর্বের রেজিষ্ট্রেশন ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। এমনকি যাদের সদস্যপদ পূর্বেই বিক্রি করে হস্তান্তর করেছে। এমন কিছু ব্যক্তিও বিলুপ্ত সমিতির নাম ব্যবহার করে কার্যক্রম পরিচালনার পাঁয়তারা করছেন। যা প্রকৃত সাম্পান মাঝি ও শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থি বলে জানায়।
ঘটনার অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ২০১৫ সালে আবুল কালাম প্রকাশ কালা মিয়া দেড় লক্ষ মূল্যে ও ২০১৩ সালে ছালামত খাঁন এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে নন জুডিসিয়াল (৩শ’ টাকা) স্ট্যামে সমিতির সদস্য পদ বিক্রি করে স্বত্ত্বহীন হয়ে যায়। যা গঠনতন্ত্রে না থাকলেও সমিতির সভায় ব্যক্তিস্বার্থে রেজুলেশন দেখিয়ে নিয়মবহির্ভূত কাজটি সম্পাদন করেন।
অভিযোগ তোলা হয়, এই ঘটনার ৫ বছর পর কালা মিয়া সমাজসেবা অফিসের এক অসাধু কর্মকর্তার সাথে আতাঁত করে ৭ বছরের ভুয়া অডিট তৈরি করেন। যেখানে সমিতির কার্যালয় হিসেবে দেখানো হয়েছে ব্রিজঘাটের একটি দোকান ঘরকে। বাস্তবে তাদের কোন সমিতির কার্যালয়ের অস্থিত্ব নেই। এমনকি সদস্য হিসেবে যাদের নাম দেখিয়েছেন তারা কেউ সদস্যও নয়। বরং কেউ রাজমেস্ত্রী, কেউ দিনমজুর কিংবা ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ি বলে মোঃ আলী জানান।
অনুসন্ধানে তথ্য মিলে, অপচেষ্টাকারীদল বড় প্রতারণারও আশ্রয় নিয়েছেন। পূর্বে যারা বিলুপ্ত সমিতির সদস্য ছিল তাদেরকে লোভের ফাঁদে জিইয়ে রাখলেন। কেননা বিনামূল্য যদি সমিতি সচল করা যায়। তবে সদস্য পদ বিক্রি করা যাবে মোটা অঙ্কের টাকায়। মূলত এই উদ্দেশ্য নিয়েই সমিতির রেজিস্ট্রেশন নিতে মরিয়া হয়ে উঠে চক্রটি। যে কারণে প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে সমাজসেবা অফিসের প্রতিবেদনসহ তাদের আবেদন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। পরে তথ্য পাওয়া যায় মন্ত্রণালয় তাদের আবেদন খারিজ করে দেন। কেননা ওই সময় ৮২৮টি সমিতি বিলুপ্তির তালিকা প্রকাশ করে অধিদপ্তর। যেখান থেকে একটি সমিতি সচল করা হলে বাকি ৮২৭টি সমিতির উপায় কী হবে?
ওদিকে, একটি বিশেষ মহল নদী পাড়ের কিছু নিরীহ মানুষকে সমিতির স্বপ্ন দেখিয়ে ঝুঁলিয়ে রেখেছেন। শিগগিরই সমিতি সচল হচ্ছে এমন তথ্য জানিয়ে নিয়মিত চাঁদাও আদায় করছেন। হয়তো বিষয়টি কথিত সদস্যদের অজানা রয়েছে। এমনকি চক্রটি বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছবি ব্যানার টাঙিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করছেন। যার কোন ভিত্তি নেই।
চাঞ্চল্যকর আরো তথ্য মিলে, ইছানগর বাংলাবাজার সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি, চরপাথরঘাটা ব্রিজঘাট সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি, ইছানগর কর্ণফুলীঘাট সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি, তোতার বাপের হাট সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি, অভয়মিত্র ঘাট সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি, নয়াহাট সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতিসহ একাধিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে প্রতিবেদকের কথা হলে তাঁদের একাধিকজন জানান, ‘যারা বিলুপ্ত সমিতিকে সচল করার অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন তাদের কেউ সমিতির সদস্য নয়।’
স্থানীয়রা জানান, চট্টগ্রাম জেলা সমবায় অফিসকে বোকা বানিয়ে সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য জানিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন আদায় করে নিয়েছে চক্রটি। প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে যা পূনতদন্ত হওয়া দরকার। পাশাপাশি সদস্যহীন বানোয়াট একটি সমিতি পূনরায় রেজিস্ট্রেশন নিতে উঠে পড়ে লাগায় প্রকৃত সাম্পান মাঝিরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জানতে চাইলে অভিযোগকারী (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) মোঃ আলী বলেন, ‘আমাদের সদরঘাট সাম্পান মালিক কল্যাণ সমিতির বর্তমান রেজিষ্ট্রেশন নং-২৮৫৬/১৭। আর আমাদের বিলুপ্ত ‘সদরঘাট সাম্পান শ্রমিক কল্যাণ সমিতি’ রেজিষ্ট্রেশন নং ছিলো ৮২৩/৮০। পূর্বে সদস্য সংখ্যা ছিল ৪২ জন। এখন তা নতুন ভাবে বেড়ে হয়েছে ৪৭ জন মতো। সুতরাং সদরঘাটে আমাদের সংগঠনের নাম ব্যবহার করে কেউ যেন কোন কার্যক্রম না চালায়। এটা আমাদের অনুরোধ।’
তিনি আরো বলেন, সমিতির সদস্যদের নাম ব্যবহার করে যাতে সুবিধাবাদী কোন পক্ষ রেজিষ্ট্রেশন হাসিল না করে। সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ করছি। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলব কোন অবস্থাতেই যেন বিলুপ্ত সমিতির নামে কোন সাম্পান মালিক বা শ্রমিক সমিতি পূনঃ অনুমোদনসহ রেজিষ্ট্রেশন না পায়।’
অভিযুক্ত আবুল কালাম প্রকাশ কালা মিয়া বলেন, ‘আমাদের সমিতি সচল আছে বিলুপ্ত নয়। আমরা গরিব মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। অনেক অসহায় মানুষকে আমরা সাহায্য করি। এক মাস আগেও আমরা সরকার থেকে ১ লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছি। যা এখনো তোলা হয়নি। এখানে আমাদের কোন ব্যক্তিগত সুবিধা নেই।’
আবুল কালামের কাছে প্রতিবেদক প্রশ্ন করেন। আপনারা যে সমিতি সচল আছে বলে দাবি করছেন তা তো ২০১২ সালের ১৩ আগষ্ট বিলুপ্ত করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সচল কিভাবে হলো তা জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসার সোহানুর মোস্তফা শাহরিয়ার বলেন, ‘সাম্পান সমিতির নামে একটা অভিযোগের অনুলিপি পেয়েছি। যেহেতু সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ করা হয়েছে। সেহেতু আমাদের ওই বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত হবে না।’
চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘লিখিত একটি অভিযোগ পেয়েছি। দুপক্ষের বক্তব্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোন অনিয়ম হলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিধি বিধান মতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘সাম্পান সমিতির অভিযোগ সমূহ বিভাগীয় অফিস থেকে মনিটরিং করা হয় না। জেলা অফিস বিষয়গুলো দেখে থাকেন। সুতরাং ওখানেই বিহীত ব্যবস্থা হবে।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার হালদার (নিবন্ধন) বলেন, ‘সাম্পান সমিতি পূনরায় সচলের বিষয়ে আমরা একটি আবেদন পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা এটা সুপারিশ করিনি। পরে না দেওয়ারও একটি অভিযোগ পেলাম। যা নথিভূক্ত করা হলো।’ উপ-পরিচালক বলেন, এটা এতটা সহজ বিষয় নয় যে, বললেই সমিতি সচল হয়ে যাবে। আসলে আইনে কোন বিলুপ্ত সমিতিকে পূনরায় সক্রিয় করার এখতিয়ার নেই।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামে বিলুপ্ত সমিতির নাম ব্যবহার করে পূনরায় রেজিষ্ট্রেশন চেষ্টা সংক্রান্ত একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে নিবন্ধন বিভাগ। যদিও বিলুপ্ত সমিতি সচল করা সম্ভব নয়।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।