সিবিএন ডেস্ক:
হাতে লাঠি-রসিদের মুণ্ডি, মুখে বাঁশি। নাম তাঁদের ‘লাইনম্যান’। পরিবহন-সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নসহ নানা ভুঁইফোড় সমিতির নিয়োগে তারাই যেন সড়কে হর্তকর্তা। গাড়িচালকদের কাছ থেকে ‘ওয়েবিল’, টোকেনের নামে চাঁদা আদায় তাঁদের কাজ। ‘ভাগের টাকা’ পকেটে ঢুকিয়ে ‘কাঠের পুতুল’ বনে যায় ট্রাফিক পুলিশও। নগরের অন্তত ৫০টি স্পট ঘিরে পরিবহন খাত থেকে এভাবেই মাসে চাঁদা আদায় করা হয় কোটি কোটি টাকা। এর মধ্যে ছয়টি চিহ্নিত স্পট থেকে উঠে তিন কোটি টাকারও বেশি।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি) বলছে, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। কোনো চালকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের মৌখিক অভিযোগ পেলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই রাস্তার মাথা, একই এলাকার বালুরটাল ট্রাক স্ট্যান্ড, পাহাড়তলী-অলংকার রুট, বন্দর এলাকা, আকবরশাহ-একে খান রুট এবং বায়েজিদ-অক্সিজেন রুটেই মূলত তৎপর এসব চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী নেতা এবং প্রশাসনের ‘যোগসাজসে’ দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে এসব চাঁদাবাজ। চাঁদার টাকা না পেয়ে গাড়িচালকদের মারধরের ঘটনা এসব জায়গায় নিত্যদিনের ঘটনা।
চাঁদাবাজরা চিহ্নিত হলেও পুলিশের ‘খামখেয়ালিতে’ পার পায় বারংবার। মঙ্গলবার টানা দুই ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি করা ৩০ জনকে আটক করেছে র্যাব। তবে এখনো আটক কারো নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি সংস্থাটি। তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাও জানা যায়নি।
শ্রমিক ইউনিয়নের একাংশের নেতৃবৃন্দের দাবি, ‘পারমিশন’ নিয়েই তারা ‘সার্ভিস ফি’ আদায় করছেন। র্যাব ‘ভুলে’ আটক করেছে তাদের। আটকদের ছাড়িয়ে নিতে র্যাবের সাথে বসে ‘আলাপ করার’ সিদ্ধান্তও নিয়েছেন তাঁরা।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই চাইবো না, আমাদের কোনো সদস্য এসবের সাথে জড়িয়ে পড়ুক। কিন্তু যদি কারো সাথে এমনটা ঘটে তাহলে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা অবশ্যই ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো। আর ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্য যদি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে সেটি যদি কেউ আমাদের মৌখিকভাবে এসে বলে তাহলে তাও আমরা আমলে নেবো।’
শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এরকম একটা সংগঠনের কয়েকজনকে ধরেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। আর বন্দর এলাকায় গাড়িপ্রতি ৩০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়-এমন একটি তথ্য আমাদের কাছে ইতোমধ্যে এসেছে। ওই টাকা যারা নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। যা তদন্তাধীন আছে। আর কোন কোন পয়েন্টে চাঁদাবাজি হয় সেটির তথ্য আমরা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’
৭৬ লাখ টাকার চাঁদাবাজির কারবার কাপ্তাই রুটে
নগরের চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই রাস্তার মাথায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চললে নিতে হয় বিশেষ টোকেন। সেই টোকেনের জন্য দিতে হয় এক হাজার টাকা। টাকা না দিলে রাস্তায় তোলা যাবে না গাড়ি, তুললে চালকদের শিকার হতে হবে নির্যাতন-নিপীড়নের। এসব ঘটনা ওই এলাকার ‘ওপেন সিক্রেট’।
জানা গেছে, অন্তত দৈনিক ৪ হাজার সিএনজি অটোরিকশা চলে এই এলাকায়। সে হিসাবে মাসিক এক হাজার টাকা করে টোকেন বাবদ ওঠে ৪০ লাখ টাকা। চাঁদা তুলতে নিয়োগ করা ‘লাইনম্যান’ দৈনিক গাড়ি প্রতি সকালে ১০ টাকা এবং বিকেলে ২০ টাকা করে নেন ‘চা খরচ’। ‘চা খরচ’ লাইনম্যানের ‘ধান্ধা’ হিসাব হয় ‘এক্সট্রা’। সবমিলিয়ে ৭৬ লাখ অর্থাৎ অর্ধকোটিরও বেশি চাঁদাবাজির টাকা উঠে শুধু এই স্পট থেকেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদাবাজদের মূল নিয়ন্ত্রক রিয়াদ ও বখতিয়ার উদ্দিন সিকদার। আর চাঁদার টাকা জমা নেন ১১ মামলার আসামি হোসেন মোহাম্মদ। মাঝে মধ্যে ‘চুনোপুটিরা’ প্রশাসনের ‘খপ্পরে’ পড়লেও তাদের ‘লিডাররা’ থেকে যান আড়ালে-আবডালে। মূলত জাহিদ, মেহেদী, বেলাল, শাহেদ, মাহমুদ, রাসেল ও হাসান নামে আরও ৭ জন রয়েছে এই চক্রের মধ্যে। শিফট ভাগ করে চাঁদার টাকা তোলেন তারা। প্রতি শিফটে টাকা তোলে ৮ জন করে। এসব চাঁদার ভাগ পায় পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারাও।
চাঁদাবাজদের খপ্পরে পড়ে হেনস্তার শিকার মো. সাগর নামে এক অটোরিকশা চালক সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘মাসে এক হাজার টাকা করে দিয়ে আমাদের টোকেন নিতে হয়। আর আমাদের গ্রাম সিএনজিগুলো। এগুলোর গ্যাস রিফিল করতে আমাদের কাপ্তাই রাস্তার মাথা আসতেই হয়। শহরে ঢুকলেই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটদের ১০ টাকা করে দিতে হয়।’
‘একদিন সকালে আমি গ্যাস নিতে আসি। সেদিন আমার কাছে টাকা ছিল না। আমাকে টাকার জন্য মারধর করা হয়। এছাড়া, প্রায়ই সিএনজি চালকদের তারা মারধর করে চাঁদার জন্য। সার্জেন্ট ডেকে গাড়ি জব্দ করায়। সার্জেন্টরাও ওদের কথা মতো চলে।’— বলেন সিএনজি অটোরিকশাচালক সাগর।
চাঁদাবাজি চলে বালুরটাল ট্রাক স্ট্যান্ডেও
শুধু কাপ্তাই রাস্তার মাথায় নয়, একই থানার অধীনে বালুরটাল ট্রাক স্ট্যান্ডেও ‘হরদম’ চলে চাঁদাবাজি। এখানেও রয়েছে কথিত ‘লিডার’। আর সেই লিডারের অধীনে চাঁদাবাজি চলে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে।
সূত্র বলছে, এই এলাকায় দৈনিক দুই শতাধিক ট্রাক যাতায়াত করে। প্রতি ট্রাক থেকে ৩০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। সে হিসাবে দৈনিক চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার টাকায়। আর এসব চাঁদা আদায়কারীদের কথিত ‘লিডার’ সবুর ও শফিক। মাসে প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি হয় এই স্পট থেকে।
মাসে ৩৩ লাখ পাহাড়তলী-অলংকার রুটে
চট্টগ্রামের ব্যস্ত সড়ক অলংকার মোড়। সেই মোড় থেকে কয়েকগজের দূরত্বেই ট্রাফিক পুলিশ বক্স। কিন্তু তাঁদের চোখে পড়ে না চাঁদাবাজির কারবার। চাঁদাবাজির অন্যতম স্পট হিসেবে এই মোড়কে স্বীকৃতি দিয়েছে গণপরিবহন চালকেরা।
জানা গেছে, এই রুটটিতে দৈনিক চলাচল করে ৩ হাজার সিএনজি গ্যাসচালিত অটোরিকশা ও টমটম। আর এসব গাড়ি চালাতে মাসে ৮শ টাকা করে দিতে হয় চালকদের। সে হিসাবে মাসে টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ২৪ লাখ টাকায়। এখানেও আছে ‘এক্সট্রা ধান্দা’র হিসাব। দৈনিক ১০টাকা করে ‘রোড খরচ’ দিতে হয় চালকদের। সবমিলিয়ে চাঁদা ওঠে দৈনিক ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মাসে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩ লাখ টাকায়।
মূলত এসব ‘কোটা’ দিতে হয় কথিত শ্রমিকনেতা মো. পেয়ার আহম্মেদকে। চাঁদার টাকা না পেলে গাড়ি চলাচলে বাধা দেওয়া থেকে শুরু করে মারধরও করা হয় চালকদের।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই রুটে শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে চলে অর্ধশতাধিক অবৈধ ম্যাক্সিমাও। প্রতিগাড়ি থেকে দৈনিক আদায় করা হয় ৫০ টাকা। মাসে এসব গাড়ি থেকে তোলা চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ হাজার টাকা। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশ থেকে ‘বাঁচতে’ মাসিক টোকেনের জন্য এসব গাড়ির চালকরা নেন দুই হাজার টাকার ‘টোকেন’। টোকেন বাবদ মাসে আদায় হয় লাখ টাকা। সবমিলিয়ে অন্তত দুই লাখ টাকার চাঁদাবাজি হয় এই গাড়ি দিয়েই।
জানা গেছে, কথিত শ্রমিক সংগঠনের হর্তাকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন নাছির, আলমগীর, সুমন, বাবু ও বাহার নামে পাঁচ ব্যক্তি। ট্রাফিক পুলিশের সামনেই বুক ফুলিয়ে প্রতিদিন আদায় করা হয় এসব চাঁদার টাকা।
বন্দরে আড়াই কোটি টাকা চাঁদাবাজি
বন্দরকেন্দ্রিক দুটি পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন বেশ সক্রিয়। তাদের মধ্যে একটি চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়ন। আরেকটি চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন। এই দুই সংগঠনের প্রকাশ্য চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ কাভার্ডভ্যান-ট্রেইলার চালকরা। শুধু চালকরা নন, চাঁদার টাকা দিতে গড়িমসি করলে নেতাদের হুমকি ধামকির ফোন পৌঁছে গাড়ির মালিক পর্যন্ত।
তবে এসব শ্রমিক নেতার দাবি, চালকরা স্বেচ্ছায় টাকা দিয়ে থাকেন, যা খরচ হয় তাদেরই সেবায়। আর এতে ‘পারমিশন’ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দৈনিক বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে অন্তত ১০ হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান। প্রতিটি যানবাহন থেকে চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়ন নেয় ৫০ টাকা এবং চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়ন নেয় ৩০ টাকা করে। সেই হিসাবে ওই দুই সংগঠনের পকেটে ঢুকে ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাসে আড়াই কোটি টাকা প্রকাশ্যে গিলছে এসব শ্রমিক নেতা।
চালকদের অভিযোগ, এই টাকার বড় একটি অংশ যায় ট্রাফিক পুলিশের কর্তাদের পকেটে। আর সেই ‘অবৈধ আয়ের’ ভাগ পায় ট্রাফিক সার্জেন্টরাও। প্রশাসনের সামনেই টাকা না দিলে হেনস্তা করা হয় চালকদের। কিন্তু তা দেখেও টু শব্দও করেন না তাঁরা। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা এসব চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিমতলা পিসি রোডে ব্যারিকেড দিয়ে ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করে।
শামসুজ্জামান সুমন নামে চাঁদাবাজির শিকার এক পরিবহন মালিক বলেন, ‘আমার গাড়ি বন্দরে ঢুকানোর সময় কয়েকজন মিলে আমার গাড়িটিকে আটকে দেয়। এ সময় তারা ৩০ টাকা দাবি করে আমার চালকের কাছ থেকে। সেই টাকা না দিতে চাইলে আমার চালককে তারা হেনস্তা করা শুরু করে। তাদেরকে আমি অনুরোধ করলেও তারা আমার গাড়ি ছাড়েনি। শেষমেশ চাঁদার টাকা নিয়ে তারা আমার গাড়ি না ছেড়ে আমাকে হুমকি-ধামকি দেয়।’
চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে ‘পরিচালনা ব্যয়’ উল্লেখ করা ৫০ টাকার একটি চাঁদার রশিদ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে ৫০ টাকার ব্যয় হিসেবে, ফেডারেশন বাবদ ৫ টাকা, ইউনিয়ন বাবদ ৫ টাকা, কল্যাণ তহবিলে ২০ টাকা এবং মৃত্যু এবং পঙ্গু সদস্যদের কল্যানার্থে ২০ টাকা দেখানো হয়েছে। সংগঠনটির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে নগরের সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায়।
আটক চাঁদাবাজ, শ্রমিক নেতাদের দাবি ‘র্যাবের ভুল’
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে একযোগে পরিবহন সেক্টরে অভিযান চালানোর নির্দেশনা দিয়েছে র্যাবসদর দপ্তর। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী নগরের বিভিন্ন এলাকায় মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) দুই ঘণ্টা টানা অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় বিভিন্ন এলাকা হতে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি করা ৩০ জনকে হাতেনাতে আটক করে র্যাব-৭। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে আটকদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আটক করা ওই ৩০ জনের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়ন এবং চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের চার নেতাকর্মীও। তারা হলেন—বখতিয়ার, প্রবীণ বড়ুয়া, শাহজাহান ও শহিদুল্লাহ।
তবে, র্যাব ‘ভুল বুঝে’ তাদের নেতাকর্মীদের আটক করেছে দাবি করে চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার রাতে বলেন,‘ আটকদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’ এর একটু পর আবার সুর পাল্টে তিনি বলেন,‘র্যাব বুঝতে পারেনি। তাই আটক করেছে। আগামীকাল (বুধবার) কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ওদেরকে ছাড়িয়ে আনবো।’
পরিবহন থেকে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষার কাজ করে থাকি। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাই ৩০ টাকা করে নিই। আমাদের পারমিশন নেওয়া আছে। এটা সরকার অনুমোদিত। আমরা জোর করে টাকা নেই না।’
একই বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের নামে আয়-ব্যয়ের হিসাব আমরা প্রতিবছর রিটার্ন জমা দেই। আমাদের সংগঠন সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের অধীনে। আমরা এই টাকা শ্রমিকদের জন্যই ব্যয় করি। আমরা চাঁদাবাজি করি না।’
র্যাবের হাতে আপনাদের সংগঠনের সদস্য চাঁদাবাজি করতে গিয়ে আটক হয়েছে মঙ্গলবার—উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের তিনজনকে আটক করেছিলো র্যাব। একজনকে অলরেডি ছেড়ে দিয়েছে। আর দুজনকে ছেড়ে দিবে। আমরা কাগজপত্র নিয়ে যাচ্ছি।’
কিন্তু একই শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হাসান মাহমুদ র্যাবের হাতে শ্রমিক আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘মঙ্গলবার আমাদের কোনো শ্রমিক নেতা আটক হয়নি। তবে বারিকবিল্ডিং জেলা ট্রাক কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের বখতেয়ার নামে একজন নেতাকে আটক করেছে র্যাব। ওনাকে ওনাদের কালুরঘাট শাখা অফিস থেকে আটক করা হয়।’
এ বিষয়ে কথা বলতে র্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. নুরুল আবছারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
আকবরশাহ-একে খানেও থেমে নেই চাঁদাবাজি:
নগরের একে খান থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত চলাচল করে অন্তত ১শ অটোটেম্পো। অথচ এসব টেম্পোর রুট পারমিট, ফিটনেস কিছুই। নেই। দৈনিক ১০০ টাকা দিলেই এই রুটে ‘জায়েজ’ হয়ে যায় এসব গাড়ি। এ হিসেবে মাসে অটোটেম্পো বাবদ ৩ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়।
এদিকে, আকবরশাহ-একে খান রুটে চলাচলকারী মিনিবাস এবং সিটিবাসেও চলে নীরব চাঁদাবাজি। জানা গেছে, এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন নারায়ণ দে। আর চাঁদার টাকা জমা নেয় সমু এবং নিপু নামে দুই ব্যক্তি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি মিনিবাস এবং সিটিবাস থেকে দৈনিক ১শ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। এই রুটে চলাচল করে অন্তত এমন দুই শতাধিক বাস। সে হিসাবে দৈনিক ২০ হাজার টাকা করে মাসে ‘অবৈধ কামাই’ হয় ৬ লাখ টাকা।
বায়েজিদ-অক্সিজেনে তৎপর ‘চাঁদাবাজ’ সিন্ডিকেট:
বায়েজিদ-অক্সিজেন রুটে চলাচল করে শতাধিক অবৈধ টমটম। এছাড়া চলে শতাধিক মিনিবাস। এসব অবৈধ টমটম ও মিনিবাস থেকে দৈনিক ২০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। এ হিসাবে দৈনিক ৮ হাজার টাকা করে মাসে আড়াই লাখ টাকা চাঁদা নেওয়া হয় নামসর্বস্ব পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নামে।
এছাড়া এই রুটে চলাচলকারী মিনিবাস ও অবৈধ টমটম চালকদের ওই শ্রমিক সংগঠনকে মাসে দিতে হয় ৮শ’ টাকা করে। সেই হিসাবে মাসে অন্তত দেড় লাখ টাকার চাঁদাবাজি হয়। আর এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন মো. সোহেল নামে এক ব্যক্তি। আর চাঁদার টাকা তোলে নুরুল হক পুতু নামে আরেকজন।
মঙ্গলবার বিকেলে র্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে যেসব সিন্ডিকেট নেপথ্যে থাকে তার মধ্যে অন্যতম চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। দূর দূরান্ত থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক থেকে তারা চাঁদা আদায় করে তখন এর প্রভাব সরাসরি পণ্যের ওপর গিয়ে পড়ে। প্রতিটি ট্রাক গন্তব্যে আসা পর্যন্ত প্রায় ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিয়ে থাকে। চট্টগ্রামেও এসব সিন্ডিকেটের তৎপরতার খবরে আমরা অভিযান চালিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘অভিযানে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় যাত্রীবাহী অটোরিকশা থেকে চাঁদা আদায়কারী ১৩ জন, বালুর টাল এলাকা থেকে চাঁদা আদায়কারী ৪ জন, পাহাড়তলীর হোটেল মেরিন সিটির সামনে থেকে যাত্রীবাহী মিনিবাস থেকে চাঁদা আদায়কারী ৪ জন, আকবরশাহ এবং এ কে খান মোড় হতে ৩ জন এবং বায়েজিদের অক্সিজেন মোড়ে যাত্রীবাহী মিনিবাস ও ট্যাম্পু থেকে চাঁদা আদায়কারী ৬ জনসহ সর্বমোট ৩০ জন চাঁদা আদায়কারীকে আটক করি। এ সময় তাদের কাছ থেকে মোট ৪১ হাজার ৫শ’ টাকা জব্দ করা হয়।’ -সিভয়েস২৪