-সিরাজুল কাদের
প্রবাস জীবনের ব্যস্ততম সময়ে অনেক প্রবাসী জীবনের আদ্যোপান্তের হিসেব কষে প্রতিনিয়ত যেখানে সে হাতডে বেড়ায় ফেলে আসা জীবনের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন কালের প্রথাগত জীবন পদ্ধতির কৃষ্টি, আচরন, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ সহ বিভিন্ন সামাজিক আচার। প্রতিটি ক্ষণে সে শিখে এবং প্রজন্ম পরম্পরায় স্থান কাল পাত্রভেদে শিখনগুলোর যথাযথ উপস্থাপনাতে নিজের অবস্থানের জানান দেয়। অবস্থান, সংস্কৃতি এবং পরিবেশের বৈচিত্রতায় কখনো কখনো নিজেকে যুত্সই উপস্থাপনে সক্ষম নাও হয় তথাপি নিজের প্রাণপন প্রচেষ্টা থাকে নিরন্তর চলমান। এমনিভাবে একে একে দুই, দু’য়ে দু’য়ে চার এর সমীকরনে একদিন বোধ শক্তি একে একে এগার এবং দু’য়ে, দু’য়ে বাইশের চৌহদ্দিতে পদার্পন করে…! তখন অদৃশ্য মনে শিহরণ জাগানিয়া অনুভূতিতে নিজেরাই কেমন জানি নিজেদেরকে একটু ম্যাচিউরড বা আপডেটেড মনে করে। আর যদি কোনক্রমে নিজেদের আর্থিক নিদের্শক প্রত্যাশিত মাত্রা অতিক্রম করে তাহলেতো অধিকাংশই বেমালুম ভূলে যায় কোথা হতে তরী মোর করেছিনু যাত্রা শুরু….! তবে তা অনুচিত কেননা ঐ ভাংগা গড়া অতীতের একেককটি প্রস্তর খন্ড ও কষ্টের তীব্র প্রসব বেদনা থেকে আজকের বর্তমানটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় ভরপুর করেছে ! আর যে বা যারা এই অতীত ভূলে যায় কালক্রমে অশনি সংকেতে ভর করে স্বল্প সময়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয় !
কালের বিবর্তনে কর্মতৎপর জীবনে যার যার অবস্থান এবং পেশার ক্রম বিন্যাস ঘটে এক চলমান স্রোতে আর এই স্রোতের জল তরঙ্গে শিখন এবং কৌশলের মনস্থাত্ত্বিক রসায়ণে অভিজ্ঞতা নামক পরাগায়ন ভর করে ধীর লয়ে। যার পরিক্রমায় প্রবাস জীবন যেন অভিজ্ঞতার এক অনন্য পাঠশালা এখানে আমরা প্রতিনিয়ত বিচিত্র এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার সম্মূখীন হয়। ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা অবয়ব, সংস্কৃতি, জীবনাচার এবং ব্যবস্থাপনা প্রতিটি অনুসঙ্গ যেন অভিজ্ঞতার রসদকে ভরপুর করতে তৎপর। তেমনি এক অভিজ্ঞতার অবতারনা থেকে কিছু বাক্য বিলাস…!
আমি জাপানে বর্তমানে যেখানে থাকি সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক বসবাস করে যার মধ্যে ব্রাজিল, পেরু, মেক্সিকো, ইরান, তুরস্ক, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, চীন,কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া এবং ফিলিপাইন সহ আরো অন্যান্য দেশের লোক রয়েছে। প্রত্যেকের নিত্য প্রয়োজনীয় স্বল্প পরিমাণ গ্রোসারীর জন্য কনভিনিয়েন্ট স্টোরে আসে আর এই কনভিনিয়েন্ট স্টোরের সার্ভিস ২৪ ঘন্টা পর্য়ন্ত।জাপানের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য কনভিনিয়েন্ট স্টোর রয়েছে সাথে থাকে বেশ বড আকারের পার্কিং তবে স্থানভেদে পার্কিং ছোট ও হয়। আমরা যেখানে থাকি সেখানে সন্নিকটে রয়েছে 7 ELEVEN কনভিনিয়েন্ট স্টোর আর এখানে আমরা বিদেশীরা বিশেষ করে বাংলাদেশী, পাকিস্তানী এবং ইন্ডিয়ানরা সন্ধ্যার পরে আড্ডাপ্রবণ হয়ে কর্মশ্রান্ত দিনের স্ট্রেস ভূলতে গল্পগুজবে মেতে উঠি যেখানে আমরা হারিয়ে যায় আকাশে প্রসন্ন ধ্রুব দ্বীপনট নাবিকের ব্রতে; আর কৃষ্ণ নটবালকের ধানক্ষেতে, সন্ধ্যায় প্রভাতে নদীনদী ডেকে ফিরি, পতঙ্গ ধনেশ পাখি দ্বারী তখন অনৈশ্বর্য বিষণ্ণ জোনাকির মিটমিটিতে, কৃষকমুখের সে সূর্যরোপনে পতিত ধানের পরতে পরতে মনে হয় যেন সে শৈশবের স্বর্ণালী অতীত আমাদের অন্তরীক্ষে বিভার ভিখারি আরো কত কি….! আমি বেসিক্যালি এশার নামাজ শেষে এখানে ঢু মারি বন্ধু- বান্ধবদের সাথে খোশ গল্পে কখনো রাত দশটা আবারো কখনো এর অধিক সময়ও হয়ে যায়। প্রথম দিকে এখানে রাত দশটার অধিক হলেই টহল পুলিশ আসত এবং আমাদের ভিন্ন তথ্য নিত- কোথায় থাকি, কি করি, কিসের জব, কোম্পানীর ঠিকানা সহ ইত্যাদি! আমাদের মাঝে কেউ কেউ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠত পাছে না উল্টো ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়! এভাবে পুলিশের টহল দল প্রায় অনুরুপ কর্মে তৎপর থাকত এক সময় পুলিশরাই বুঝতে পারল যে আমরা যারা এখানে গল্প করি তাদের তেমন কোন বেড ক্রাইম রিপোর্ট নেই নিছক গল্পগুজব করা ছাড়া। এরপর থেকে পুলিশের পেট্রোল কার আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাই কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করেনা..! এখানে মনে মনে ভাবার অবকাশ নেই যে এই গল্পবাজ লোকগুলো সব ধোয়া তুলসী পাতা; মোটেও নই বরন্ছ ম্যাক্সিমাম ডানপিটে, দুরন্ত, উচ্ছল ছেলেপিলেগুলো এখানে সরল গলির সুবোধ বালকের বেশে একাকার হয়েছে বা হচ্ছে। উল্টো রথে ছড়ে খবর নিলে দেখা যায় যারা বিদেশে এসেছে তাদের বেশির ভাগই শয়তানের হাবিলের ভাই কাবিলের প্রজন্ম..!জাপানে তাদের হুররে হুয়া কেয়া মজা বনের রাজা কুপোকাত অবস্থা, কিন্তু কেন? পরে আসছি এই টপিক্সে..!
আজ নতুন এক অভিজ্ঞতার স্বাক্ষী হলাম যার কারনে উপরোক্ত বর্ণনার ফিরিস্তি। প্রতিদিনের ন্যয় আজও আমরা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী এবং পাকিস্তানী বরাবরের মত কনভিনিয়েন্ট স্টোরে জডো হয়েছিলাম এবং গল্পে মত্ত ছিলাম বার ছিল শনিবার রাত প্রায় দশটা। দেখি আমাদের সামনে প্রায় দশটা মত লাউড প্রপেলার বাইক নিয়ে অনুর্ধ্ব বিশের পনের – বিশজনের অধিক কিশোর- কিশোরী নিজেদের মধ্যে উচু আওয়াজে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে, আবার এক গ্রুপ রেড ট্রাফিক সিগন্যালে বাইক নিয়ে প্রপেলার সাইল্যানসারে ক্রমাগত বুঁ….বুঁ…..বুঁ….শব্দে কান জ্বালা পালা করে ফেলছে। আবার এরাই একসাথে জডো হয়ে একটু উচ্চস্বরে একজন আরেকজনকে খুনসুটি করছে আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অজানা কোন এক জাপানী পেট্রোল পুলিশকে কল দিয়ে বসে সাথে সাথে পুলিশ হাজির। উল্লেখ্য এখানে শনি- রবি সাপ্তাহিক ছুটি আর এই কারনে জাপানী এবং বিদেশীরা বয়সানুসারে ভিন্নভাবে এই ছুটির দিনগুলো উপভোগ করে-ঘুরতে যাওয়া, খেতে যাওয়া, শপিং করা,লং ড্রাইভ, বারবিকিউ ক্যাম্পিং করা, ক্যান্ডল লাইট ডিনার এবং ক্লাবিং সহ ভিন্ন ভিন্ন বিনোদনে মত্ত হয়!
পুলিশ আসার পরে সরাসরি আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ সাত জাপানীদের কাছে গেল এবং জিজ্ঞেস করল এখানে কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কার কি কাজ, কোথায় আবাস স্থান, কারা এখানে হুলস্থুল করছিল ইত্যাদি..! এর মাঝে জাপানীদের একজন বলল কিছু চ্যাংরা পোলাপাইনরা চিল্লাচিল্লি করছিল পাঁচ দশ মিনিট আগে তারা বেরিয়ে গেছে। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে পুলিশদল আমাদের কাছ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করবেতো দুরের কথা পাশেও আসেনাই…! কারন এরা আগে থেকে জেনে গেছে এই বিদেশীগুলো এখানে শুধু গল্পগুজব করা ছাড়া অন্য আকাম- কুকামে নাই..! গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় ন্যায়- অন্যায়ের বালাই উড়িয়ে দেয়া, সামাজিক শৃংখলার তোয়াক্কা না করা, আইন ভাংতে পারাটা যেন অঘোষিত আইন, পেশী এবং বাহুবলের দাম্ভিকতায় পরিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা থেকে উঠে আসা এই যুবকরা আজ এখানে অনেক মার্জিত এবং অতি ভদ্রতায় দিন যাপন করছে কেন? পূর্বের টপিক্সের ধারাবাহিকতায় বলতে গেলে এই জাপানে এক সময় হিংস্রতা, সহিংসতা, গোত্রগত এবং এলাকাভিত্তিক দলাদলী, খুন-খারাবী সবই ছিল। সময়ের বিবর্তনে রিসার্চ ওরিয়েন্টেড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক উল্লেখিত ব্যধি এবং দুরাচারগুলোকে দূরীকরণে যথায়থ স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা এবং কার্যকর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ইন্টার সেক্টরাল সিস্টেম ডেভেলপ করা হয় ফলশ্রুতিতে এক সময়ের এই হিংস্র জাতি আজ বিশ্বের দরবারে অন্যতম সভ্য জাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আর আমরা অনিয়মের গ্যাঁড়াকল থেকে আসা সিস্টেমের খোলসে বোতল বন্দি বিদেশীরা অসম্ভব সভ্য বিদেশীতে পরিণত হয়েছি, এখন এখানকার পুলিশ আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করেনা কোন আকামে জড়িত আছি বা ইত্যকার প্রশ্ন! তাই জাপানীদের রিচার্স ওরিয়েন্টেড ইন্টার সেক্টরাল গুড গভর্ণনেন্স সিস্টেমের আলোকে আমরাও কি পারিনা আমাদের সোনার বাংলাকে সাজাতে….!?নিশ্চয় পারি, শুধুমাত্র কর্তা মহলের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটলে হয়! দেশের প্রত্যন্ত এরিয়াতে ডিজিটালাইজেশন আজ দৃশ্যমান; এগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ইন্টার সেক্টরাল সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট ও সম্ভব। আর কত লুটোপুটি..!? আমরা একটু একযোগে আগানোর চেষ্টা করিনা অন্তত আগামী প্রজন্মদের জন্য সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা প্রণয়নে; যদি হ্যাঁ হয়, কীর্তিমানদের জয়গান চলবে নিরন্তর অন্যথায় আগামীর কঠিন চ্যালেন্জে আমরা হারিয়ে যাব আর প্রজন্মময় অভিসম্পাত এই জাতির কপোলে গিয়ে ঠেকবে…হেলায়তো বেলা অনেক কেটে গেছে চলুন না, একযোগে নতুন ধারাতে নব দিগন্তে…… সার্বিক পরিবর্তনের মধুর মিছিলে..!