মোঃ আরিফ উল্লাহ
অপার সম্ভাবনাময়ী একটি খাত শৈবাল চাষ, আর শৈবাল চাষের জন্য উপযোগী স্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ,উপযুক্ত শ্রমবাজার সবই আছে আমাদের দেশে। আমাদের কাছে খানিকটা নতুন মনে হলেও আমাদের এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশ এই শৈবাল চাষের মাধ্যমে তাদের জিডিপিতে অসামান্য অবদান রাখছে।
শৈবাল মূলত এক ধরনের নিম্নশ্রেণির স্বভোজী জলজ সুকেন্দ্রিক উদ্ভিদ, যা এককোষী বা বহুকোষী হয়ে থাকে। অন্য জলজ জীবের ন্যায় এরা দেহ, কান্ড, মূল কিংবা পাতায় বিভক্ত নয়। সারা বিশ্বে প্রায় ত্রিশ হাজার প্রজাতির শৈবাল আছে বলে ধারনা করা হয়, এর মধ্যে বেনথিক শৈবাল, লিখোফাইটিক শৈবাল, এন্ডোফাইটিক শৈবাল, এপিফাইটিক শৈবাল, ফাইটোপ্লাঙ্কটন শৈবাল ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। আমাদের আশেপাশে লবনাক্ত কিংবা আধা লবনাক্ত সমুদ্র, নদী-নালা, এমনকি পুকুরের অগভীর স্থানে এই শৈবালের উপস্থিতি দেখা যায়।
শৈবালের বৈশিষ্ট আলোচনা করতে গেলে কিছু বৈশিষ্টসমূহের কথা বলতেই হয় যেমন, এরা অপুষ্পক, স্বভোজী, সমাজদেহী হয়ে থাকে,এদের আলাদা কোনো পরিবহন টিস্যু নেই, রেণুথলি বা স্পোরাঞ্জিয়া সব সময় এককোষী হয়, সেলুলোজ ও পেকটিন দিয়ে এদের কোষ প্রাচীর গঠিত, এদের খাদ্য শর্করা, যদিও কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।
লাল, সবুজ এবং বাদামী রঙের শৈবাল হয়ে থাকে, যার মধ্যে সবুজ এবং বাদামী রঙের শৈবাল খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং লাল শৈবাল থেকে হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন করা হয়। সর্বপ্রথম ১৬৪০ সালে টোকিও তে এর চাষ শুরু হয় এবং ১৯৪০ সালের দিকে বাণিজ্যিকধারায় চাষাবাদ হয় কিন্তু ১৯৭০ এর শুরুর দিকে এর বিপ্লব ঘটে। শৈবাল চাষ খুবই সহজ এবং সাশ্রয়ী, শৈবাল মূলত দুই পদ্ধতিতে চাষ করা হয়, প্রথমত নেট পদ্ধতি, যেখানে বাঁশের সাথে জাল বেঁধে শৈবাল চাষ করা হয়, অন্যটি লাইন পদ্ধতি, যেখানে সমুদ্রের অগভীর অঞ্চলে পুতে রাখা বাঁশের উপরের অংশে রশি টানানো হয়। এর পর এই রশি এবং জালের সাথে শৈবালের বীজ বাঁধা হয়, এবং ১৫ দিন পরপর শৈবাল আহরণ করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি শুকনো শৈবাল ১৪ থেকে ১৬ ডলার, প্রতি একর এলাকায় মাসে দুইবার শৈবাল আহরন করলে প্রায় ৩৫-৪০ কেজি শুকনো শৈবাল পাওয়া যায়। বছরে ৬ থেকে ৭ (নভেম্বর-এপ্রিল) মাস এই সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করা সম্ভব, এই শৈবাল থেকে নানান ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি হয়। যার মধ্যে রয়েছে, স্যুপ, নুডলস, শরবত, এগারএগার, মিল্ক শ্যেক, সল্টেস দুধ, সমুচা, সালাদ, বিস্কুট, বার্গার, চকলেট, সিঙ্গেরা, জেলি, চানাচুর, ক্যান্ডি, পেস্টি, কাস্টার্ড, রুটি, ক্রিমচিজ, পনির, ফিশফিড, পোলট্রিফিড, সবজি জাত খাবার ইত্যাদি। ওষুধ উৎপাদনেও এর গুরুত্ব অনেক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, গ্যাসট্রিকসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি হয় এই শৈবাল থেকে, এছাড়াও খাদ্য সংরক্ষণের জন্য, আইসক্রিমের উপাদান ল্যাবরেটরিতে ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনের জন্য, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট তৈরি করা হচ্ছে শৈবাল থেকে। শৈবালে রয়েছে ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৬, ভিটামিন ‘কে’ ভিটামিন ‘ডি’, আয়োডিন, লৌহ, জিংক, ফসফরাস, আয়রন, ফ্যাট, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, সালফার, প্রোটিন, কপার ইত্যাদি। এর বাহিরেও শৈবাল পরিবেশ দূষণ রোধ করে, বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমান বৃধি করে, বায়ুফুয়েল তৈরিতে ভূমিকা রাখে, সমুদ্রে মাছের অবস্থান, মাটির বয়স ও গোয়েন্দা সাবমেরিনের অবস্থান নির্ণয় করতে সাহায্য করে।

বর্তমানে বিশ্বে বাজারে সামুদ্রিক শৈবালের চাহিদা প্রায় ২৬ মিলিয়ন টন, যার মূল্য প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন ডলার। এই চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে চীন এবং বাকি ৬০ শতাংশের যোগান দেয় অন্যান্য দেশগুলো, কিন্তু এতে ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ উল্ল্যেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে, যেখানে বাংলাদেশের নাম যুক্ত করা খুব বেশি কষ্টসাধ্য নয়। আমাদের দেশের প্রায় ১৯ টি উপকূলীয় জেলা রয়েছে যার মধ্যে প্রায় প্রতিটি জেলা কম বেশী শৈবাল চাষের উপযোগী। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর পরিক্ষামূলক চাষে সফলতা মিলেছে। আমাদের দেশে এই শিল্পের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের প্রান্তিক জেলে পরিবারের জন্য এই শিল্প হতে পারে এক অনন্য বিকল্প আয়ের মাধ্যম, এছাড়াও এর মাধ্যমে তৈরি হবে অসংখ্য কর্মসংস্থান, যার ফলে বেকার তকমা থেকে মুক্তি পাবে হাজারো যুবক- যুবতী, নিশ্চিত হবে বিশাল সমুদ্র চরের উৎকৃষ্ট ব্যবহার, অর্জিত হবে বৈদেশিক মদ্রা।
শৈবালের উপকারী দিকের বিপরীতে কিছু অসুবিধাও রয়েছে, যেমন জলাধারে পুষ্টির পরিমান বেড়ে গেলে জলাধারে পানি দূষিত হয়ে খাবার ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। উদ্ভিদের রোগ দেখা দিলে, মাছেরও রোগ সৃষ্টি দেখা দেয়, রাস্তাঘাট পিচ্ছিল করতেও শৈবাল ভূমিকা রাখে। সর্বোপরি এর ক্ষতিকর দিক থেকে এর সম্ভাবনা অনেক বেশী এবং একটু সচেতন হলে এই অসুবিধা থেকে মুক্তি পাওয়া খুবই সহজ
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় শৈবাল এমন একটি খাত যেখানে, নাম মাত্র মূলধন ও পরিশ্রম বিনিয়োগ করে অধিক পরিমানে আয় করা সম্ভব, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে রক্ষারকবজ হিসেবে কাজ করতে পারবে। এখন প্রয়োজন সরকারের সঠিক পদক্ষেপ ও সহযোগিতা এবং আন্তরিকতার। সেই সাথে সহজ শর্তে উপকূলীয় চরাঞ্চল ব্যবহার নিশ্চিত করা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে অন্তর্ভূক্ত করা ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের সক্ষমা বৃদ্ধি করা, তবেই দেশের এই শিল্পের বিপ্লব ঘটা সম্ভব।

লেখক, মোঃ আরিফ ঊল্লাহ
উন্নয়ন কর্মী, কোস্ট ফাউন্ডেশন
ইমেইলঃ arifcbiu@gmail.com