সাজ্জাদুল করিম

ভারতকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর কারণও বহুবিধ। ৪৭ ইং সালে স্বাধীনতা লাভের পর হতে ভারত কখনো সামরিক শাসনে পরিচালিত হয়নি। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে কখনো কোন অগণতান্ত্রিক শক্তিও ভারতের শাসন ক্ষমতায় আসীন হয়নি। গনতান্ত্রিক সৌন্দর্য,এর উৎকর্ষ, বিকাশের জন্য ভারত সারাবিশ্বে সমাদৃত ছিল। পশ্চিমা রাষ্ট্রসমুহের নিকটও ছিল ভারতের আলাদা কদর। ছিল বিশেষ মর্যাদা।

বর্তমানে তা ভূলন্ঠিত। ভারতীয় গনতন্ত্রের সৌন্দর্য এখন আর অবশিষ্ট নেই। এর জন্য দায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর হতে ভারতীয় গনতন্ত্রের পচন শুরু হয়। মোদী ও বিজেপির কতৃত্ববাদী শাসন, স্বেচ্ছাচারিতা, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচারী মনোভাবের কারনে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় গনতন্ত্র আজ বিপন্ন এবং হুমকির সম্মুখীন।

ভারতের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথিত মানহানীর অভিযোগে তাঁকে দুই বছরের সাজা দেওয়া হয়। এই রায়ের মাধ্যমে ভরতীয় গনতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি টুকে দেয়া হয়েছে। কি অপরাধ ছিল রাহুল গান্ধীর? দেশের প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। যা গনতান্ত্রিক দেশে হরহামেশাই হয়। রাহুল গান্ধীর সমালোচনা একেবারে মিথ্যাও ছিল না। রাফায়েল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ে সরকার ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয নিয়েছিল। রাহুল গান্ধী সরকারের দুর্নীতির অভিযোগে কেবল বলেছিলেন, “সব চোরেরা কেন তাদের পদবিতে মোদী ব্যবহার করে?” তাও ২০১৯ইং সালে কর্ণাটক বিধান সভার নির্বাচনের পূর্বে এক রাজনৈতিক বক্তৃতায়।

ব্যস! এতে ক্ষেপে গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি। রাহুলকে শায়েস্তা করতে হবে। হোক তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় বিরোধী নেতা। মোদির দলের এক চেলা মামলা করেন গুজরাটের আদালতে। রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে। মানহানীর মামলা। গুজরাটের শহর সুরাটের ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে। গুজরাট মোদির নিজ রাজ্যও বটে। বিচারক মহোদয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মান রক্ষার্থে সাজা দিলেন রাহুল গান্ধীকে। যিনি ভারতের প্রধান বিরোধী মুখ। মোদীর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্ধি।

দুই বছরের সশ্রম কারাদন্ড। আবার জামিনও দিলেন। তবে দয়া করে নয়। যেহেতু দুই বছর সাজা। জামিনেরও বিধান আছে। বিচারক রায় স্হগিত করেননি। কেবল একমাস মুলতবী রেখেছেন। এই হল বিশ্বের মহান ও বৃহত্তম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দৈনন্দিন রোজনামচা! রাহুল গান্ধীর যদি এ অবস্থা হয়,অন্যরা ভারতে কত অনিরাপদ তাহা সহজেই অনুমান করা যায়।

এতে ক্ষান্ত থাকেনি নরেন্দ্র দামোদর মোদী ও বিজেপি। এরও কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতায় কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিলেন। কব্জা করতে চেয়েছিলেন কোর্টের স্বাধীনতা। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে সরকার নগ্ন হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন কলেজিয়াম সিস্টেম। এ ব্যবস্হায় প্রধান বিচারপতি সহ পাঁচজন বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারক নতুন বিচারপতির নাম সুপারিশ করেন। সরকার কলেজিয়াম বাতিল করে নিজস্ব লোককে বিচারক হিসাবে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টর দৃঢ়তায় এ যাত্রায় তা রক্ষা পায়। এরপরও সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরণ রিজিজু, পশ্চিম বঙ্গের সাবেক আলোচিত রাজ্যপাল,বর্তমানে ভারতের মহামান্য উপরাষ্ট্রপতি জয়দীপ ধনখড়ের প্রপাগান্ডা থেমে নেই। যে কোন সময় মোদি ও বিজেপি সরকার সুপ্রিম কোর্ট কব্জায় নিতে পারে।

নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের খ্যাতি ছিল গগনচুম্বী। আর তখন কমিশনের প্রধান ছিলেন টি এন সেশন নামে সাবেক এক আমলা। ১৯৯০ ইং হতে ১৯৯৬ ইং পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। টি এন সেশনের সততা,দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁর অধীনে নির্বাচন ছিল অবাধ ও হস্তক্ষেপমুক্ত। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরই নির্বাচন কমিশনকে পরিণত করেন সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে। ইতিমধ্যে সরকারের নীলনকশা বাস্তবায়নে তল্পিবাহক নির্বাচন কমিশন উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস এবং মহারাষ্ট্রে শিবসেনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়।

মোদি ক্ষমতায় আসার আগে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইয়ের বেশ সুনাম ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাদের সুনাম ও মর্যাদা শুন্যের কোটায়। সিবিআই, ইডি প্রভৃতি তদন্ত সংস্থার কার্যক্রম আজ প্রশ্নবিদ্ধ। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ব্যবহার করে প্রায় প্রতিটি রাজ্যে কেবল বিরোধী রাজনীতিবিদদের প্রতিনিয়ত হেনস্থা, হয়রানি,হামলা, মামলা,কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।

ভারতের একমাত্র মুসলিম প্রধান রাজ্য কাশ্মীর। কাশ্মীর ছিল সাংবিধানিকভাবে বিশেষ সুবিধাভোগী রাজ্য। বিজেপি ও মোদি কলমের এক খোঁচায় কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা বাতিল করে। কাশ্মীরের মুসলিম রাজনীতিবিদদের হয় কারাগারে নয়তো গৃহবন্দী করা হয়। মুসলমান সম্প্রদায়কে টার্গেট করে মোদি ও বিজেপি সরকার এই হীন ষড়যন্ত্র করেছেন।

অথচ ভারতে বিশেষ সুবিধাভোগী আরও রাজ্য রয়েছে। ন্যাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্যেরও সাংবিধানিক সুবিধা রয়েছে। তাদের সুবিধা বাতিল হয় না। কারন ঐ সমস্ত রাজ্য খৃষ্টান অধ্যুষিত। ব্যবস্হা নেয়া হয় কেবল মুসলমানদের বিরুদ্ধে। সাম্প্রদায়িকতার নিকৃষ্টতম নজীর এটি।

ভারত বহু ধর্ম,বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও বৈচিত্রের এক দেশ। ভারতীয় গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সত্বা এতদিন ভারতকে শক্তিশালী ও একতাবদ্ধ রেখেছিল। বর্তমানে বহুত্ববাদী ভারতে ফাটল ধরেছে। এই ফাটলের মেরামত ও বিনির্মান প্রয়োজন। পূর্বের ভারতের গনতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সহাবস্থান, পরমতসহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা বিশাল ভারতের অখন্ডতার জন্য বর্তমানে ভীষণ জরুরী।

সাজ্জাদুল করিম
সিনিয়র আইনজীবী
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত।