আ.ন.ম মাঈন উদ্দিন
সাধারণ অর্থে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। শিক্ষা কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো অর্জনে সহায়তা করে। আর কারিকুলাম হলো শিক্ষার একটি বিশেষ স্তরের শিক্ষণীয় বিষয়ের সমষ্টি বা পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু , শিক্ষাদানের পদ্ধতি, মূল্যায়নের কৌশল, বিভিন্ন উপকরণ ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মসূচি এই সবকিছুই কারিকুলামের অন্তভুক্ত। তাই শিক্ষার ক্ষেত্রে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষাক্রম বিস্তরণের আমি একজন মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে যতটুকু প্রতিনিয়ত অবলোকন করে আসতেছি, আমার সেই ক্ষুদ্র জ্ঞানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সহজ ভাষায় কিছুটা ব্যক্ত করার চেষ্টা করবো। আমার এই লিখনি কারো উদ্দেশ্যে কিংবা হেয় করার মানসে নয়। আমি মনে করি, এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষক সমাজেই একমাত্র অগ্রনী ভুমিকা
পালন করতে পারে। ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে বিভিন্ন নোটিশ তথা প্রজ্ঞাপন প্রকাশ চলমান রেখেছে। প্রথমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে, প্রশিক্ষণের জন্যে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছে, সেই তালিকা ভিত্তিক সকল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করে নাই। যদিও এই প্রশিক্ষণ অনেক শিক্ষকদের জন্য প্রযার্প্ত নয়, এই কথাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ অনেকের মুখে শোনা যায়।
অপরদিকে এটুআই কতৃর্পক্ষ মুক্তপাঠে বিভিন্ন কনটেন্ট ও ভিডিও এর মা্যধমে প্রশিক্ষণ গ্রহণে জোর দেন কিন্তু ০১. একটি প্রতিষ্ঠানে কত জন শিক্ষক সেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সার্টিফিকেট অর্জন করেছে ? ০২. কয়জন শিক্ষকই বা বুঝে ও শোনে সেই প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করেছে ? এতে দেখো যায়, বিদ্যালয়ে কিছু কিছু শিক্ষক রয়েছে তারা এক্সপার্টদের সহযোগিতায় রেডিমেট উত্তর দিয়ে ও ভিডিও দেখার সময় শুধুই টাইম পাস করে সার্টিফিকেট অর্জন করেছে। নয়তো বা ইউটিউবের সহযোগিতা নিয়েছে। বাস্তবতঃ প্রতিটি বিদ্যালয়ে এমন কিছু শিক্ষক আছেন যারা নতুন কারিকুলাম বুঝে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে আজ চমৎকার ভাবে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে ইয়াং শিক্ষকদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু কিছু শিক্ষক আছেন যাদের অন্তরে নতুন কারিকুলাম নিয়ে এখনো অনীহা, আর এটিই বাস্তব।
সুতরাং নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের কিছু অন্তরায় তুলে ধরার চেষ্টা করবো: ০১.মন্ত্রণালয়ের আদেশে প্রধান শিক্ষকদের ইন হাউজ ট্রেইনিং এর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলে ও কয়জন প্রধান শিক্ষক সেটির যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ? ০২. মন্ত্রণালয় থেকে প্রদত্ত রোটিন অনুযায়ী ক্লাশ গ্রহণের জন্য প্রধান শিক্ষক/ সহকারি প্রধান শিক্ষক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কিনা, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের যথাযথ মনিটরিং হচ্ছে কিনা ? ০৩. অনেক শিক্ষক আছেন, যারা প্রশিক্ষণ গ্রহণকৃত নির্দিষ্ঠ বিষয়ে ক্লাশে না গিয়ে প্রশিক্ষণ বিহীন শিক্ষককে ক্লাশে পাঠায়, সেটি কতৃর্পক্ষ মনিটরিং করতেছে কিনা ? ০৪. কিছুদিন আগে মাউশি এর একটি প্রজ্ঞাপন /নোটিশে গুগল ফরমে তথ্য চেয়েছে। যেখানে “হলেও হ্যাঁ, না হলেও হ্যাঁ”, “থাকলে ও হ্যাঁ, না থাকলে ও হ্যাঁ ” মার্ক করে সাবমিট দেয়া হয়। আশা করি এটি সবাই বিশ্বাস করবেন। সে খবর কর্তৃপক্ষ রাখে কি না ? মুক্তপাঠে সার্টিফিকেট গ্রহণ না করেও সবাই করেছে মর্মে ঠিক মার্ক দিয়েছে এমনও হয়ত থাকতে পারে। ০৫. আরেক প্রজ্ঞাপনে অভিভাবক মতবিনিময় সভা আয়োজনের কথা বলা হলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে অভিভাবদের সাথে কারিকুলাম বিষয়ে মতবিনিময় সভা করা হয়েছে কিনা ? কিন্তু গুগুল ফরমে না করে হ্যাঁ মার্ক করেছে, সেটি কর্তৃপক্ষ মনিটরিং করেছে কিনা ? কিন্তু যে সব প্রতিষ্ঠান, অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে তাঁরা আজ অনেকটা সফল। ০৬. কিছু শিক্ষক যথাযথ পাঠদান করে—ই যাবেন, আর কিছু শিক্ষক, কিছুই করবে না — সেই রকম ও অনেক ক্ষেত্রে আছে। ০৭. শিক্ষক সহায়ক বহি (টিজি) অনুসরণ করে একজন শিক্ষক পাঠ দান করতেছে কি না ?
এই সব বিষয়ে যে সকল প্রতিষ্ঠান যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিস মনিটরিং তথা যাচাই পূর্বক সেটির বিরোদ্ধেই বা কি ব্যবস্থা নিয়েছে ? আর কয়জন প্রধান শিক্ষক সেটি তদারকি করেন ? সেটি —ই— আজ প্রশ্ন থেকে যায়। উপরোক্ত বিষয়গুলো কারিকুলাম বাস্তবায়নে অন্তরায় নয় কি ? এ ক্ষেত্রে আমার অভিমত হলো, এখানে সিনিয়র শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষক দায়ী নয়। এই বিষয়গুলো সার্বজনীন নয় বরং আমি মনে করি যে, যদি শিক্ষক সহায়ক (টিজি) অনুসরণ পূর্বক, একজন শিক্ষক পাঠদান করে থাকেন তাহলে একটি সফল পাঠদান হিসেবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা সম্ভব। একজন প্রধান শিক্ষক ও সহকারি প্রধান শিক্ষক আন্তরিক হলে উপরোক্ত বিষয় গুলো তাঁদের নীতি নৈতিকথা ও দৃষ্ঠিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে নিয়মিত শিক্ষকদের পাঠদান মনিটরিং করলে, কারিকুলাম বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে এই সকল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর সহ উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিস যথাযথ মনিটরিং করবেন। আর এই কাজ টি যতদিন না করা হবে ততদিন যতই প্রজ্ঞাপন, অফিস আদেশ আসুক, কারিকুলাম বাস্তবায়নে অন্তরায় হয়ে থাকবে।
আর কিছু উল্লেখ যোগ্য বিষয় হচ্ছে ০১.শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন করা অপরিহার্য। ০২.শিক্ষকদের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণ। ০৩. প্রর্যাপ্ত শ্রেণি কক্ষ স্থাপন ০৪. যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোলা মাঠ নেই, অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাদের খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
উন্নত ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং জ্ঞানভিত্তিক ও নৈতিকতা বোধসম্পন্ন জাতি গঠনে যথোপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা অপরিহার্য। আমি আশাবাদী হতে চাই, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের নতুন কারিকুলাম এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক ও মাস্টার ট্রেইনার (আইসিটি ও নতুন কারিকুলাম), জেলা অ্যাম্বাসেডর (এটুআই)।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।