রুদ্র সুশান্ত:

কবিতা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সৃষ্টির উন্নত ফসল। কবিতা মানুষের বুদ্ধি নাকি আবেগ থেকে সৃষ্টি হয়েছে সেই দ্বন্দ্বের এখনো অবসান হয়নি।
তবে মানুষের মনের অন্তরালের সমস্ত দুর্ভেদ্য অনুভূতির যাপনচিত্র কবিতার মানষপটে ফুটানোর প্রচেষ্টা করেন একজন কবি। আপাতদৃষ্টিতে মানুষের পোশাকের মতো কবিতা হলো মনের আবরণ। কোথায় যেনো পড়েছিলাম- কবিতা পড়তে হয় ‘in between lines’ এ। কবিতায় বলা শব্দগুলোর মাঝখানে যে না বলা শূন্যস্থানটা রয়ে যায় সেটা যখন একজন পাঠক মনের অভ্যন্তরে ভাবকল্পনায় উত্তোলন করতে পারে তখন কবিতার স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায়। এবং তখনই একজন কবি স্বার্থক কবি হয়ে উঠেন। বর্তমান সময়ের গদ্য কবিতার ব্যাপক উত্থান, সময়ের পরিবর্তনের ফলে আধুনিক কবিতা বলতে মূলত গদ্য কবিতাকে বুঝানো হচ্ছে। সেই স্রোতস্বিনী নদীর প্রবাহে দাঁড়িয়ে বাংলা কবিতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সনেট রচনা করেছেন কবি রফিক আনম। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষা এবং বাংলা কবিতা অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। বলতে গেলে বাংলা কবিতার জল অনেক দূর গড়িয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নতুন নতুন আঙ্গিকে কোন না কোন কবি বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করছেন।

কবিতার ভাবনা কি একান্ত ব্যাক্তি নির্ভর? শুধুমাত্র কবির মনোজগতকেই পরিপুষ্ট করে? কবিতার প্রেক্ষাপট এবং কবিতার আঙ্গিনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন এখন পাঠকমনে। বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ শাখা কবিতা পাঠককে নানান ভাবে আলোড়িত করে। একজন কবি কবিতার ভিতর যে ভাবনাকে জন্ম দেন পাঠক সেই ভবনাকে একান্ত নিজের ভিতর নিজস্ব সত্ত্বায় ধারণ করেন। এভাবেই একটি কবিতার সার্থক কবিতা হয়ে উঠে।

কবিতায় সমাজের রক্তচোষা শ্রেণিকে তিনি তির্যকভাবে আক্রমণ করেছেন, অর্জুনের তীর দ্বারা যেনো বারবার বিপক্ষের সৈন্যদের আক্রমণ করা হচ্ছে- কেমন আছি কবিতায় রফিক আনম বলেন- “উচ্চবিত্ত রক্তচুষে ভুঁড়িমেদ বাড়ায় বিদেশে”
একইভাবে আরেক কবিতা লিখেছেন- “ভূস্বর্গে নরক এসে লজ্জা দেয় বসন্ত বিলাপে” তার কবিতায় ঘুরে ঘুরে এসেছে প্রতিবাদের দ্রোহ। এক পসলা বৃষ্টির পর সবুজ আহবানে জেগে উঠার দর্শন নিয়ে তিনি কবিতায় কলমের কালিতে এঁকেছেন মানুষের সামাজিক জীবনের চাহিদা।

তার কবিতাই তৃপ্তি ও তৃপ্তির দোলাচল আছে, ভালোবাসার পূর্ণতা আছে, ধর্মের টালবাহানা আছে, প্রায় সম্মিলিত কন্ঠে আলোকবর্তিকার আহ্বান আছে, সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার আকুতি আছে, কবিতার বুকে তিনি সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সিদ্ধহস্তে এঁকেছেন। যেমন “প্রকৃতির প্রতিশোধ” কবিতায় লিখেছেন-
“মানুষের অত্যাচারে নষ্ট পরিবেশে/
অস্তিত্ব সংকটে আজ বর্ষার কদম/
মেঘ এসে অভিমানে ফেরে অন্যদেশে”
গাছপালা কেটে নিজেদের বনভূমি নিজেরাই ধ্বংস করছি, রাতারাতি পাহাড়ের মাটি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, প্রেমের নামে আর কোন উদ্যান অবশিষ্ট থাকছে না। এর প্রতিবাদস্বরূপ শব্দের গাঁথুনিতে নিজস্ব অঞ্চল তৈরি করেছেন কবি রফিক আনম। শব্দে শব্দে তার প্রতিবাদে নিজস্ব ধরণ আছে। ধর্মকে পুঁজি করে যারা নিজস্ব অভিমতকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয় তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কবি “ধর্মের নামে চর দখল’ কবিতায় লিখেছেন-
“নদী বয়ে নেয় বিষাক্ত কিছু রক্ত/
ঘাটে ঘাটে ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা, জ্বালাও পোড়াও/
দূর গগন অবাক নয়নে দেখে/
কোথাকার জল কোথায় গড়ায়”
প্রবাদ আছে- “ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ । সুতরাং এই থেকে সাধারণ মানুষের আত্মবিশ্বাস হয় যে- অত্যাচারীরা যতোই অপকর্ম করুক না কেন দিনশেষে সৃষ্টিকর্তা সব খারাপ কাজের লাগাম টেনে ধরবেন ।

কবি রফিক আনম কবিতার বুকে নিজস্ব প্রেক্ষাপট এঁকেছেন। কবিতার ভিতর নিজস্ব ভঙ্গিমায় ছোট ছোট গল্প যেনো বুনে দিয়েছেন পাঠকের মনে। চট্টগ্রাম শহরকে ভালোবেসে তিনি,চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস থেকে বর্তমান- কর্ণফুলী নদী, সবকিছুকে কবিতার আবহে জড়িয়ে এনেছেন ভালোবাসার চপলা হরিণীর মতো।
“হার্দিক শহর” কবিতায় বলেন-
“ওলন্দাজ ফিরিঙ্গিন জাহাজ যখন নোঙ্গর ফেলল/
চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক বন্দর তখন বিশ্বের নগর/
আধুনিক সভ্যতার ঐতিহ্য বাহক ফরাসি বণিক/
এদেশের মানুষের মননে বুনেন শৈল্পিক বিপ্লব”

জীবনধারণ থেকে সমাজ, ধর্ম থেকে বিজ্ঞান, শহর থেকে গ্রাম, নদী থেকে পাহাড়, লাল নীল বাত্তির ফাঁকে তিনি সযত্নে বুনেছেন শহরের কোলাহল। অপরিকল্পিত উন্নয়নকে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। প্রেমিকার দ্রোহ থেকে বিরহ, ভালোবাসার ছন্দপতন, প্রকৃতি প্রেম সবকিছু-ই তিনি কবিতায় সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা বলেছেন, উচ্চবিত্ত শ্রেণির শাসন, নির্যাতন, শোষণের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। কবিতা পাঠ করতে করতে একজন পাঠক অনায়াসে হারিয়ে যাবে তার শৈশবে কিংবা গ্রামীণ কোন পরিবেশে। উন্নয়নের নামে যেসব ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে সেগুলো যেনো চোখের উপর ভাসবে একজন পাঠকের। কবির মেধা ও মননের সংমিশ্রণে শব্দের ক্ষুরধারায় একজন পাঠক নিজেকে আত্ম-আবিষ্কার করার চরম সুযোগ পাবেন, এখানেই একজন কবির সার্থকতা।

কাব্যগ্রন্থ- রক্তবৃষ্টি
কবি- রফিক আনম
প্রচ্ছদ- ধ্রুব এষ
প্রকাশনী- আগামী প্রকাশন
প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ইংরেজি
মুদ্রিত মূল্য-২৫০ টাকা।

লেখক
রুদ্র সুশান্ত
কবি ও সাহিত্য আলোচক