ইতিহাস: মুক্তিযুদ্ধ

আহমাদ ইশতিয়াক

মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও নেতৃত্বের কারণে তিনি পেয়েছেন বীর উত্তম খেতাব। তার খেতাবের সনদ নম্বর ৩।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর চট্টগ্রামের অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা একে অস্ত্র তুলে নেওয়ার ঘোষণা হিসেবেই ধরে নিলেন। ৮ মার্চ সকালে মেজর জিয়াউর রহমান ও ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ গোপনে ছাদে উঠে যান। তাদের মধ্যে বিদ্রোহ নিয়ে পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা হয়। তারা ঠিক করেন, বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। মেজর জিয়াউর রহমান ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অফিসাররা অপেক্ষা করতে লাগলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানার জন্য।

১৭ মার্চ চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের সামরিক আইন সদর দপ্তরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরীর নেতৃত্বে গোপন বৈঠক হয় ৪ বাঙালি অফিসারের মধ্যে। এই ৪ অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর আমীন আহমদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। বৈঠকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী প্রথমে মেজর জিয়াউর রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন বুঝতে পারছ পরিস্থিতি?’ জবাবে মেজর জিয়া বললেন, ‘মনে হচ্ছে ওরা হামলা চালাবে।’ তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী বললেন, ‘সশস্ত্র অভ্যুত্থানই এখন একমাত্র পথ।’

এম আর চৌধুরীই প্রথম বাঙালি অফিসার, যিনি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আহ্বান জানান। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, স্টেশনের একমাত্র বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারকে এই পরিকল্পনার বাইরে রাখতে হবে। ঠিক হলো, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরীর নেতৃত্বেই বিদ্রোহ করবে বাঙালি সেনারা। এদিকে হামলার প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে পাকিস্তানিদের।বাঙালি অফিসারদের দিকে নজরে রাখা হচ্ছে। বাঙালি অফিসাররাও পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা চালাচ্ছেন।

২১ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর জেনারেল হামিদ খান চট্টগ্রামে যান। এক মধ্যাহ্নভোজে পাকিস্তানি অফিসারদের কানাঘুষা ও জেনারেল হামিদ খানের এক উক্তিতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, বাঙালিদের ওপর ভয়াবহ হামলা আসন্ন। সেই মধ্যাহ্নভোজে জেনারেল হামিদ খান যেন বাঙালি অফিসারদের চিনতেই পারলেন না। মেজর জিয়াউর রহমানের অনুসন্ধানী দৃষ্টি ও মন তখন খুঁজছে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। তিনি এগিয়ে গেলেন জেনারেল হামিদ খানের দিকে। জেনারেল হামিদ খান তখন ২০তম বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতমীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি নির্দেশের গলায় উর্দুতে বললেন, ‘দেখ ফাতমী, অ্যাকশন খুব দ্রুত এবং কম সময়ের মধ্যে হতে হবে। আমাদের পক্ষের কেউ যেন হতাহত না হয়।’

পাকিস্তানি এই ২ অফিসারের কথা শুনে মেজর জিয়া পরিস্থিতি বুঝে গেলেন। সেদিন বিকেলে তিনি ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের বাসায় গেলেন এবং অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার বললেন, তাকে জেনারেল হামিদ খানের বৈঠকে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। তাকে পাকিস্তানি অফিসাররা বিশ্বাস করে না। তখন মেজর জিয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কী মনে হচ্ছে?’

জবাবে ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার বললেন, ‘সামথিং ফিশি!’ মেজর জিয়াউর রহমান বললেন, ‘ফিশি নয়। তারা বড় চক্রান্তে মেতেছে।’ পরদিন ২২ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইপিআর সেক্টর দপ্তরের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিক মেজর জিয়ার কাছে এসে বললেন, ‘সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের জলদি বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। আপনি বিদ্রোহ ঘোষণা করুন।’ তখন মেজর জিয়া খোলাখুলিভাবে তাকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানালেন।

২৫ মার্চ ক্যান্টনমেন্টের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় প্রচুর রদবদল হলো। এদিন ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে গেলেন জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, জেনারেল আনসারী, মেজর জেনারেল মিঠা খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল খোদাদাদ খান। ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার ও মেজর আমীন আহমদ চৌধুরীকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হল। ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারের বদলে স্টেশন কমান্ডার হলেন জেনারেল আনসারী এবং ইপিআরের সেক্টর কমান্ডার হলেন কর্নেল শিগারী। এই রদবদলে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন বাঙালি অফিসার ও সেনারা।

এদিকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরী। চট্টগ্রাম বন্দরে তখন খালাসের অপেক্ষায় অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত। এই অস্ত্র যেন পাকিস্তানি সেনারা না পায়, সেজন্য রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলল জনতা। এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ দেওয়া হলো বাঙালি সেনাদেরই। রাত ১১টার দিকে কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া মেজর জিয়াউর রহমানকে ১ কোম্পানি সেনা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার আদেশ দিলেন। এই আদেশের অর্থ বোধগম্য হলো না জিয়ার কাছে।

রাত সাড়ে ১১টার দিকে জানজুয়া মেজর জিয়াকে নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে ক্যান্টনমেন্টথেকে বন্দরের উদ্দেশে পাঠালেন। কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেডের জন্য সামনে এগোতে দেরি হচ্ছিল। আগ্রাবাদের কাছে বড় একটি ব্যারিকেড পড়ল। মেজর জিয়া ট্রাক থেকে নামলেন। ঠিক এমন সময় ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান একটি গাড়ি থেকে নেমে জিয়াকে এক পাশে টেনে নিয়ে বললেন, ‘পাকিস্তানিরা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছে। কী করবেন? সময় মাত্র আধা মিনিট।’ মেজর জিয়া নির্দেশের গলায় বললেন, ‘উই রিভোল্ট!’

তিনি ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামানকে ফিরে গিয়ে ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ব্যাটেলিয়ন তৈরি করার কথা বলতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সব অফিসারকে গ্রেপ্তার করতে নির্দেশ দিলেন। এরপর তার পাশে থাকা পাকিস্তানি অফিসার ও বাকি পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেন এবং ট্রাক ঘুরিয়ে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেলেন। মেজর জিয়া যখন গাড়ি নিয়ে কমান্ডিং অফিসার জানজুয়ার বাড়িতে গেলেন, জানজুয়া তখন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। তার ধারণা ছিল, জিয়া ততক্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরে বন্দী হয়ে গেছেন।

জানজুয়াকে গ্রেপ্তার করে ষোলশহরে নিয়ে যান মেজর জিয়া। এ সময় তিনি অফিসার্স মেসে মেজর মীর শওকত আলীকে বিদ্রোহের কথা বলেন। তৎক্ষণাৎ মীর শওকত আলী বিদ্রোহে যোগ দেন। তখন জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে জনপ্রতিনিধি ও বেসামরিক অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তাদের না পেয়ে তিনি টেলিফোন অপারেটরকে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিদ্রোহের কথা ঘোষণা করতে বলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আর চৌধুরীকেও ফোন করেন জিয়া। কিন্তু তিনি জানতেন না ততক্ষণে গুরুতর অসুস্থ এম আর চৌধুরীকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা।

২৬ মার্চ দিবাগত রাতে প্রায় আড়াইশো বাঙালি সেনা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মেজর জিয়া। এরপর কিছু সেনা ষোলশহরে রেখে তিনি চলে যান কালুরঘাটের দিকে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর বেলাল মোহাম্মদ, অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুক এবং মাহমুদ হোসেন একে একে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ২৭ মার্চ সকালে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। কিন্তু তার প্রথম ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ঘোষণা করার বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। পরে সংশোধন করে তিনি ২৭ মার্চ সকাল ১১টার দিকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

ইংরেজিতে দেওয়া ঘোষণাটির বাংলা হচ্ছে, ‘আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রাদেশিক কমাণ্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি, আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি, যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সব জাতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্ব শান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সব দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এৰং বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার।’

২৭ মার্চ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গলের সেনারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ২৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন বিমান বোঝাই করে চট্টগ্রামে পৌঁছলে শেষ পর্যন্ত আর চট্টগ্রাম শহরের দখল রাখতে পারেননি জিয়াউর রহমান। চট্টগ্রাম শহরের দখল না রাখতে পারলেও ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কালুরঘাটে থেকে ইস্ট বেঙ্গলের সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই যুদ্ধে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ২০ বেলুচ রেজিমেন্ট।

১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনায় মেজর জিয়াউর রহমানকে কমান্ডার করে গঠন করা হয় ১ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত। ২৫ জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন জিয়াউর রহমান। এ সময় তার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী,রাঙ্গামাটি, মিরসরাই, রামগড়, ফেনীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একাধিক যুদ্ধ হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ২৬ জুন মেজর জিয়াউর রহমানকে সেক্টর কমান্ডার করে গঠিত হয় ১১ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল জেলা এবং নগরবাড়ি-আরিচা থেকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদী ও তীর অঞ্চল। ৭ জুলাই ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ২য় ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাটারিনিয়ে গঠিত হয় জেড ফোর্স ব্রিগেড। এই ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান বিখ্যাত সব যুদ্ধের নির্দেশনা ও পরিকল্পনা করেছিলেন। কামালপুরের প্রথম যুদ্ধ, বিলোনিয়ার যুদ্ধ, নকশী বিওপির যুদ্ধ, বাহাদুরাবাদ যুদ্ধ, দেওয়ানগঞ্জ থানা আক্রমণ, চিলমারী উভচর অভিযান, হাজীপাড়া, ছোটখাল, গোয়াইনঘাট,টেংরাটিলা, গোবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলাই চা-বাগান, ধামাইচা-বাগান, জকিগঞ্জ, আলি-ময়দান, এমসি কলেজের যুদ্ধ, ভানুগাছ যুদ্ধ, কানাইঘাট যুদ্ধ, বয়মপুর যুদ্ধ, ফুলতলা চা-বাগান যুদ্ধ সহ অসংখ্য যুদ্ধ মেজর জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও পরিকল্পনায় হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে উত্তরাঞ্চলের স্বাধীন অঞ্চলগুলো নিরাপদ রাখা ছিল জিয়াউর রহমান ও তার অধীনে গঠিত জেড ফোর্সের অন্যতম প্রধান কাজ। এর অংশ হিসেবে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় জেড ফোর্স বেশ কয়েকটি অঞ্চল স্বাধীন করে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলে।

জিয়াউর রহমানের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের আগস্টের শেষের দিকে কুড়িগ্রামের রৌমারীকে স্বাধীন করে মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হয় এবং ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট এস আই বি নুরুন্নবি খানকে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পক্ষে গড়ে তোলার জন্য প্রশাসনিকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইসঙ্গে মেজর শাফায়েত জামিলকে ওই এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে লেফটেন্যান্ট নুরুন্নবি খান দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন।

জিয়াউর রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালে বগুড়ার গাবতলী উপজেলায়। ১৯৫৩ সালে কাকুল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৫৫ সালে কমিশন লাভের পর তিনি করাচীতে স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২ বছর পর ১৯৫৭ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসার পরে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভের পর ১৯৬৯ সালে মেজর পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনি গাজীপুরের জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদে কর্মরত ছিলেন। পরে ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে যোগ দেন জিয়াউর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ই মেজর থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ৪৪তম ব্রিগেডের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি কর্নেল পদে বাংলাদেশসেনাবাহিনীর উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান এবং ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিগেডিয়ার এবং একই বছরের অক্টোবরে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে এক বেতার ভাষণে জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। পরে ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র নবম খণ্ড

‘সেদিন চট্টগ্রামে যেমন করে স্বাধীনতা লড়াই শুরু হয়েছিল’

দৈনিক বাংলা, ২৬ মার্চ ১৯৭২

বাংলাপিডিয়া

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

(ডেইলি স্টারের সৌজন্যে)